সোমবার, জুলাই ০৫, ২০১০

Feast of La Mercè 2009

The giants of Barcelona.প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তায় বার্সিলোনা সব উৎসবের সেরা উৎসব “Feast of La Mercè” পালন করে থাকে। ওদের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে এ উৎসবের সাথে সংশ্লিষ্ট। বার্সিলোনার অত্যন্ত জনপ্রিয় এ উৎসবের সময় পুরো শহরই উৎসবের মঞ্চে রূপান্তরিত হয়। ঐতিহ্যবাহী লোক কাহিনিভিত্তিক নাটক, পালা, গান থেকে শুরু করে আধুনিক কনসার্ট কিংবা নাচের অনুষ্ঠান সেপ্টেম্বরের ২৩ থেকে ২৬-২৭ তারিখ পর্যন্ত বার্সিলোনাবাসীর রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।

৬০০ মঞ্চের এ বিশাল আয়োজন কিন্তু কোথাও কোনো বিশৃংখলা নেই। আর তা সম্ভব হয় স্থানীয়দের সতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আর প্রশাসনের সুনিপুণ তত্বাবধানে। এক বছরের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় পরবর্তী বছরের পরিকল্পনা, আর এতে অর্থ যোগানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ উৎসবের সমস্ত আয়োজন সকল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তাই পর্যটকদের কাছে এর আবেদন অনেক বেশি।

২০০৯ এর সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ দুপুরের পর গেস্টহাউসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, এমন সময় বাইরে অনেক্ষণ যাবৎ বিউগল, বাঁশি আর ড্রামের একটানা চলমান সুরে বুঝতে পারলাম সামনের রাস্তায় কোনো আনন্দমিছিল হচ্ছে। কৌতূহল মেটাতে বারান্দায় আসতেই দেখি এলাহি কারবার। ছোট্ট গলি মতন রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার মানুষ গিজগিজ করছে আর এর মাঝখান দিয়ে হেসে খেলে বাজনা বাজিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে দৈত্যাকৃতির সব মানুষ। একদলের পেছনে আরেক দল, তারপর আরো, এর কোনো বিরাম নেই। বারান্দা থেকে কিছুক্ষণ দেখে নিচে নামলাম, যতদূর চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ, ছেলে, বুড়ো, বাচ্চা সবাই আছে, এরই মাঝে ছোটরা ফুটপাথ ধরে বসে গেছে আর বড়রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে।

একটার পর একটা বাজনা বাজিয়ের দল আসছে, এদের মধ্যমণি হয়ে আছে দৈত্যাকৃতির কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র। রাজা-রানী, জলদস্যু, বীর যোদ্ধা, নাবিক, আবিষ্কারক, নর্তকী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের চেহারাধারী এদের কেউ কেউ আবার চারদিকে চকোলেট বিলিয়ে দিচ্ছে।

কয়েক কিলোমিটার লম্বা এ মিছিল আমার সামনে দিয়ে যেতে দুঘন্টার উপর সময় নিলো।

আজকের ছবির গল্প এই দৈত্যাকার পুতুল আর তাদের মিছিল নিয়েই, চলুন তাদের কিছু ছবি দেখা যাক।


The giants of Barcelona.The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

The giants of Barcelona.

শনিবার, জুলাই ০৩, ২০১০

দার্জিলিং এ ভিক্ষুক

ভারতীয় মন্দির গুলোতে দুটো ব্যাপার আপনার দৃষ্টি কাড়বেই। এক, সেখানকার বানর আর দুই ভিক্ষুক। নানান ধরণের আর কিসিমের ভিক্ষুক চোখে পড়ে সেখানে। ২০০৮ এ শেষ বার যখন দার্জিলিং গেলাম সেখানকার মহাকাল মন্দিরের ভিক্ষুকদের খুব কাছে থেকে খেয়াল করেছি। এর মাঝে পাশাপাশি বসা তিন জন আমার দৃষ্টি কেড়েছিলো।

Beggars at stairway of Mahakal temple

Beggar at stairway of Mahakal Temple

Beggars at stairway of Mahakal temple

প্রথম ভিক্ষুকের ছবি দেখুন, জাতে মুসলমান, কিছুটা শান্ত শিষ্ট ভাব নিয়ে চুপচাপ একপাশে বসেছিলো, আমি ছবি তুলতে গেলেই ভুরু কুঁচকিয়ে আমার দিকে তাকালো, হয়তো মনে মনে ভাবছিলো আমি না আবার তার ব্যবসার কোন ক্ষতি করে ফেলি।

দ্বিতীয় জন জগৎ সংসারে নিষ্পৃহ মনে হলেও এর গল্প ইন্টারেস্টিং। আমি যখনই ছবি তুলতে যাই তখনই ক্যামেরা থেকে মুখ সরিয়ে নেয়। ভিক্ষা তার পারিবারিক ব্যবসা। ভোর ছয়টা বাজলেই এক টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি খাবার, একটা লাঠি, এক বোতল পানি আর হাতে ছাতা নিয়ে মন্দিরে উঠার সিড়িতে জায়গা করে নেয়। মাথায় লাল সালু জড়িয়ে আর কপালে সিঁদুরের টিপ পড়ে শুরু হয় ভিক্ষার আশায় বসে থাকা। ঠিক সুর্য ডোবার সাথে সাথে পাশের মসজিদ থেকে আজ্বান ভেসে এলে আবার হাঁটতে হাঁটতে নেমে আসে।

তৃতীয় জন বরঞ্চ এদের উলটো, প্রানবন্ত, দর্শনার্থী দেখলে ডেকে কাছে আনে, লাল নীল সুতা কিংবা ফিতা ধরিয়ে দেয় হাতে, বিনিময়ে যা পায় তার পরিমান অন্যদুজনের তুলনায় বেশি। আমি ছবি তুলতে গেলে হাত তুলে থামালো, হিন্দিতে বললো “একটু সেজেগুঁজে নিই”, এরপর পোজ দিয়ে ছবি তুলতে দিয়ে আবার দেখতে চাইলো কেমন উঠেছে, সেই সাথে জেনে নিলো কোন পত্রিকায় ছাপা হবে কী না।
ছবি তিনটা তুলেছি ২০০৮ এর অক্টোবরের ১১ তারিখ।

রবিবার, জুন ০৬, ২০১০

পেনাং পেনাং ...

এর আগে জানিয়েছিলাম পাঁচ ঘন্টা ড্রাইভের পর অবশেষে পেনাং পৌঁছেছি। অরূপের গাড়িতে আমি, রিতা, মাতিস, অভিক আর অরূপ নিজে। পেনাং এ ঢুকে প্রথমেই যা করেছি তা হলো পরদিন স্নোরক্লিং এর টিকিট কনফার্ম করা। সেটা হয়ে গেলে রাজ্যের আলস্য আমাদের জড়িয়ে ধরে। আমি দেশে একটানা ১০ ঘন্টার উপর ড্রাইভ করলেও ক্লান্ত হইনি কখনও, কিন্তু এখানে পেছনে বসে থাকার অনভ্যস্ততায় অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিলো। গতবার তিওমেন যাবার সময় অনেকখানি রাস্তা আমার হাতে স্টিয়ারিং তুলে দিলেও এবারে অরূপ মহানন্দে গাড়ি চালাচ্ছিলো, আমিও কিছু বলি নি।

যাই হোক আসুন আবারো মূল গল্পে ফিরে যাই।


বালি হাই

Streets of Georgetown সন্ধ্যা নামি নামি করছে। আকাশও মেঘলা, কয়েকটা গাড়ি ইতোমধ্যেই হেড লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঠিক করলাম কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ডিনার সেরেই হোটেলে উঠব। গাড়ি চললো গার্নি ড্রাইভের দিকে। ১৯৫১ সালে তৎকালীন বৃটিশ রাষ্ট্রদুত স্যার হেনরী গার্নিকে মালয় কম্যুউনিস্ট গেরিলারা এ রাস্তায় গুলি করে মেরেছিল। গুলির সময় সাথে থাকা স্ত্রী আর ড্রাইভারের জীবন বাঁচাতে উনি রোলস রয়েস থেকে নেমে যান এবং নিহত হন। মালয় কম্যুউনিস্ট পার্টির নেতা চিন পেং পরবর্তিতে জানিয়েছেন সেটা ছিলো একটা নিয়মিত টহলের ঘটনা এবং কয়েকদিন পর পত্রিকার খবরে তারা নিহতের পরিচয় জানতে পারেন।

20100417_9999_5 অরূপ এর আগেও এদিকে এসেছে, সুতরাং রাস্তা খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। এ ফাঁকে চুপিচুপি একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমাদের সচল মাশীদের জন্ম কিন্তু এই পেনাং-এ। জর্জটাউনে সাগরের পাড় ঘেঁষে চমৎকার রাস্তা গার্নি ড্রাইভ, একপাশে নিচু রেলিং এর ওপারে সমুদ্র অন্যপাশে বেশিরভাগই খাবারের দোকান, স্টেশনারি শপ, প্রচুর টুরিস্ট হেঁটে বেড়াচ্ছে সমুদ্রের পার ধরে, সময়টা ভাটার, রেলিং থেকে কিছুটা দূরে শান্ত সমুদ্র আস্তে আস্তে আরো দূরে নেমে যাচ্ছে, দুয়েকটা সামুদ্রিক পাখি ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে তাতে। এপারের নিয়ন সাইনগুলো আস্তে আস্তে আলো ছড়াতে শুরু করলে আমরা এসে পৌঁছালাম চমৎকার রেস্টুরেন্ট “বালি হাই”এ। ঢোকার দরজায় বড় বড় লেখা “If it swims we have it”।

প্রায় ৫০০ জনের বসার ব্যবস্থা রাখা বিশাল এই রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায় না তেমন কোনো সামুদ্রিক প্রাণী নেই। আর আশ্চর্য যে সবই জীবন্ত! একপাশে বিশাল বিশাল ট্যাঙ্কে ভেসে বেড়াচ্ছে ৫/৬ কেজি ওজনের অস্ট্রেলিয়ান লবস্টার থেকে শুরু করে নানান জাতের মাছ আর কাঁকড়া, কাঁকড়ারও আছে প্রকারভেদ, আলাস্কান স্পাইডার থেকে শুরু করে ৮ কেজি ওজনের রাজ কাঁকড়াও দেখলাম। আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেই কিছুক্ষণ পরই খাবার টেবিলে চলে আসবে, চাইলে পাশে কাচ দিয়ে ঘেরা রান্নাঘরের ভেতরে রান্নাটাও দেখে নেয়া যায়।

আমরা বসেছিলাম মূল শেডের বাইরে রাস্তার দিকে ছোট ঝুপরির নিচে, এদিকটা খোলা, তাকালেই সমুদ্র, একটু পর আমাদের দৃষ্টি আটকে দিয়ে গাড়ি পার্ক করা শুরু হলো, খাওয়ায় মন দিলাম আমরা।

চমৎকার স্বাদের এক টেবিল ভরা খাবার শেষ করে আমাদের আর উঠতে ইচ্ছা করছিলো না, এমন সময় শুরু হলো আকাশ কাঁপিয়ে ঝড়বৃষ্টি। আমরাও আড্ডা আর বিশ্রামের সময় পেলাম। ঘন্টা খানিক পর বৃষ্টি ধরে এলে উঠলাম, তখনও হোটেল ঠিক করা হয় নি আমাদের।


বাটু ফিরিঙ্গি

Penang street souvenir shop মালয়েশিয়ান ভাষায় বাটু মানে পাথর, সে অর্থে জায়গাটার নাম ফিরিঙ্গিদের পাথর। পেনাং এর উত্তর-পুবে বাটু ফিরিঙ্গি এর সুন্দর বিচ আর রাতে বসা হকার মার্কেটের জন্য বিখ্যাত। অনেকগুলো সুন্দর হোটেল পাহাড়ের কোল বেয়ে প্রায় বিচের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। জর্জটাউন থেকে বেশ আঁকাবাঁকা আর উঁচুনিচু রাস্তা ধরে এদিকে আসতে হয়। রাতে থাকার জন্য আমরা বেছে নিয়েছিলাম এখানকারই ডি'ফিরিঙ্গি হোটেল। পরদিন ভোরে আমাদের তুলে নেবার জায়গা এখানথেকে হাঁটা পথে পাঁচ মিনিট।

পরদিন ভোর ছয়টায় বাস ধরতে হবে, ডেকে তোলার দায়িত্ব আমি নিয়ে যার যার রুমে। চাবি ঘুরিয়ে ঢুকতেই অভ্যর্থনা জানালো বিশালাকায় ইঁদুর।


পুলাও পায়ার

IMG_7288 ভোরে সঠিক সময়ে উঠার বাড়তি সতর্কতা হিসাবে হোটেল ম্যানেজারকে বলে রাখলেও ভোরে ঠিক সময়মতো উঠতে পেরেছিলাম সবাই। ডাকতে এসে যদি ফিরে যাই সেজন্য দরজা খোলা রেখেই ঘুমিয়েছে অভিকরা। হাতমুখ ধুয়ে বাসের অপেক্ষায় হলিডে ইনের লবিতে পাঁচ মিনিট আগেই আসতে পেরেছি। বাসও এলো সময়মতো, আমরাও উঠে বসলাম, গাইড এসে সবার হাতে প্লাস্টিকের ব্যান্ড পরিয়ে দিয়ে গেল, পরবর্তী কয়েক ঘন্টা এটাই আমাদের টিকিট।

20100419_9999_166 ভোরে রাস্তায় তেমন ভিড় নেই, রাস্তায় মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে ২/১ জন কে তুলে নিয়ে জেটিতে এসে দেখলাম আমাদের মতন জনা পঞ্চাশেক দাঁড়িয়ে আছে ফেরির অপেক্ষায়। পেনাং থেকে পায়ার ফেরিতে দুঘন্টা উত্তরে, লাংকাউই থেকে দক্ষিণে এক ঘন্টা। প্রতিদিন এ দু দ্বীপ থেকে ১০০ জনের অনুমতি মেলে পায়ারে যেতে। স্নোরক্লিং কিংবা স্কুবা এগুলোই থাকে উদ্দেশ্য। মালয়েশিয়ার অন্য সব স্নোরক্লিং সাইটের চাইতে এখানকার খরচ অনেক বেশি।

দু ঘন্টা পর তীর থেকে আধ কিমি দূরে পায়ার এর ভাসমান জেটিতে নেমে চারদিক একবার দেখে নিলাম। পানির নিচে কোরালের উপর ভাসমান ৪৯ বাই ১৫ মিটারের জেটি, তার উপর বসার জন্য গোল করে সাজানো টেবিল চেয়ার, কয়েকটি টয়লেট আর বাথরুম, একপাশে খাবার জায়গা আর স্যুভেনির শপ। চারদিকে নীল পানি, এর মাঝে কিছু জায়গা ঘেরাও দেয়া টুরিস্টদের জন্য, তার বাইরে সাঁতার কাটা নিষেধ। নিচে পানিতে তাকালে হরেক রকমের মাছ আর কোরাল চোখে পড়ে।

IMG_7286 টেবিলের উপর মাস্ক, একপাশে ফ্লিপার আর লাইফ জ্যাকেট। এক এক করে পড়তে পড়তে গাইডের বক্তব্যও শুনে নিলাম। সিঁড়ি বেয়ে পানিতে নামার সময় নিচে তাকালে কয়েক মিটার নিচের মাটি পরিষ্কার দেখা যায়, কোরালের পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ভেসে বেড়াচ্ছে নানান প্রজাতির মাছ, খুব কাছে এসে গা ছুঁয়ে যায়, আবার ধরতে গেলে পালিয়ে যায়। পানির নিচে আলোছায়ার অদ্ভুত খেলা। উপরে কড়া রোদ। মাস্ক ঠিক থাকলে একটানা নিচে তাকিয়ে ভেসে থাকা সম্ভব। এখানকার সরবরাহ করা মাস্কগুলো অতি ব্যবহারে নতুনত্ব হারিয়েছে। মাঝে মাঝেই নোনা পানি ঢুকে যায়, নিঃশ্বাসের গরমের সাথে নোনা পানিতে চোখ জ্বলে।

IMG_7316 মাতিসের সাইজের মাস্ক মেলে নি, যেটা পড়েছে তাতে একটু পরপরই পানি ঢোকে, ফ্লিপারটাও সাইজে একটু বড়, তাতেও তার উৎসাহের কমতি নেই, সাঁতার কেটেই আনন্দ করছে। রিতার অবস্থাও তথৈবচ। সে আবার সাঁতার জানে না। মাতিস মাঝে মাঝেই ওর মাকে উৎসাহ দিচ্ছে, ‘মা মা এভাবে করো’।

IMG_7308 আমি নেমেছিলাম ক্যামেরা হাতে, একটু পর সেটা তুলে দিলাম অভিকের কাছে। এখানকার কোরাল সুন্দর, মাছ আর সামুদ্রিক প্রাণীর সংখ্যাও বেশি। জেটির নিচে কাচ দিয়ে ঘেরাও দেয়া কেবিন আছে, তাতে দাঁড়িয়ে থাকলেও নিচের সৌন্দর্য অবলোকন করা যায়।

দুপুরের খাবার ব্যবস্থা জেটিতেই, বুফে। অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে ক্ষুধা ভালোই পেয়েছে। পেটে ক্ষুধা নিয়ে খাবারের মান বিচার করি নি। খাওয়ার পর সবাই শার্ক দেখতে গেলেও আমি আবার পানিতে নেমেছিলাম।

Mahamariamman Temple বিকেলে ফিরতি যাত্রা, লানকাউই থেকে ফেরি এলে এক এক করে উঠে পড়লাম, মাঝখানে একটু ঝিমুনি এলেও উঠে বাইরের ডেকে চলে এসেছি। চারদিকে পানির উপর জেগে থাকা দু একটা পাহাড়ের মাথা আর দূরে পেনাং এর হাইরাইজগুলো আবছা আবছা দেখা যায়, ফেরির গতি ভালোই, ডেকের রোদ গায়ে অসহনীয় উঠার আগেই ফেরি জেটিতে চলে এলো। সেখান থেকে শেষ বিকালে হোটেল পৌঁছালাম। কথা ছিলো সেদিনই কুয়ালালামপুর ফিরবো। কিন্তু দেখা গেল সবাই আরেকদিন থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি।


বিচ আর হকার মার্কেট

20100418_9999_12 হোটেলের ঠিক উলটো দিকে রাস্তার পাশে বিশাল খোলা পার্কিং লট, সেখান থেকে পায়ে চলা পথ নেমে গেছে বিচের দিকে। পার্কিং লটের ঢোকার মুখে পাশের পাকা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একচালা স্যুভেনির শপ। হরেক রকমের জিনিস, কিছু সেখানকার নিজস্ব তৈরি হলেও বেশির ভাগই ভিয়েতনাম থেকে আনানো। হোটেল থেকে বের হয়ে অরূপ আর অভিক নিচে বিচে চলে গেলে আমরা মার্কেটে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম। বড় একটা কাঠের প্লেটে জর্জটাউনের রাস্তা আঁকা, তাতে আবার সাদা ঝিনুক বসানো, দেখেই পছন্দ হলো, আবার ঝিনুক বসানো কাঠের টিস্যু বক্স। দামাদামি করতে যেয়ে দেখলাম দোকানদার বাঙালি। কেনাকাটা সবে মাত্র শুরু হয়েছে তেমন সময় নিচ থেকে ফোন, মামা তাড়াতাড়ি আসেন, গোলাপি সানসেট, আমরা দৌঁড়ালাম।

20100418_9999_5 বিচ সুন্দর, এরইমাঝে জেটস্কির ভমভম আওয়াজ দৃষ্টি সেদিকে টানে। তাকিয়ে দেখি ওর পেছনে দড়িতে বেলুন বেঁধে উড়ছে কয়েকজন। আবহাওয়া খারাপ হচ্ছে দেখে মাতিস আর রিতা কোমরে দড়ি বেঁধেও উঠতে পারল না। একটা বাঙালি ছেলে ঘোড়া ছুটিয়ে মাতিসকে নিয়ে গেল। আমার ক্যামেরা ব্যস্ত হয়ে উঠার আগেই শুরু হলো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। পেনাং এর বৃষ্টি, কখন আসে কখন যায় কোনোই ঠিক নাই। ছুটলাম সবাই পারের দিকে। ঘোড়ার সহিস ছেলেটা মাতিসকে নিরাপদে পারে পৌঁছে দিয়ে গেছে।


ভারতীয় খাবার, রাতের পেনাং, আর ম্যান ফর ম্যান, লেডিস ফর লেডিস

20100417_9999_18 বৃষ্টি থামতে থামতে রাত নেমে এসেছে পেনাং-এ। রাস্তাঘাট ভেজা, এরই মাঝে লোক চলাচল শুরু হয়েছে আবারো, তিন চাকার রিকশাও দেখলাম কয়েকটা। আশে পাশের দোকানগুলো ঝাঁপ খুলে তৈরী। ঠিক করলাম রাতের খাবার খেয়েই মার্কেটে ঢুকব। কোথাও বেড়াতে গেলে স্থানীয় খাবারের প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব থাকলেও কাছাকাছি ভারতীয় খাবারের দোকান দেখে ঢুকে পড়লাম। নামেই শুধু ভারতীয়, মান আর স্বাদ কিংবা দামের তুলনায় পরিমাণ কোনটাই আমার পছন্দ হয়নি।

Penang street souvenir shop এবারে ঘোরাঘুরি, টিপটিপ বৃষ্টি, নানান জাতের আর পদের শোপিস, ঘড়ি, ঘর সাজানোর সাজসরঞ্জাম, চুলের ফিতা, হারবাল ক্রিম, বাঘ আর বানরের তেল, ট্রাভেল ব্যাগ, জুতা কিংবা স্যান্ডেল, আইসক্রিম, ক্রোকারিজ, টিশার্ট, স্কার্ট, বাটিকের কাপড়, কাঠের কাজ করা লাইট শেড, বই, সিডি, ছোট খাটো বৈদ্যুতিক সামগ্রী কোনো কিছুরই অভাব নেই এই মার্কেটে। এরই মাঝে ব্যাগের ওজন বাড়তে থাকল, সাথে চললো ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক।

20100418_9999_80 আমরা ঘুরছি এক দোকান থেকে অন্য দোকানে। এক পাশে কাগজ-পেন্সিল নিয়ে চিত্রকরের দল বসে গেছে, তাদের সামনে এক তামিল পরিবার মূর্তির মতন বসে আছে। আস্তে আস্তে কাগজে ফুটে উঠছে তাদের চেহারা। পাশেই সিংহলি মালিকাধীন স্যুভেনিরের দোকান তার আলোকসজ্জার গুণেই ভেতরে টেনে নিলো আমাদের। চমৎকার সুন্দর সব জিনিস, দামও তেমন চড়া। অনুমতি নিয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম। দোকান বন্ধ হবার সময়ও ত্রিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে, অগত্যা আমরা বের হলাম হোটেলে ফিরব বলে। গল্প করতে করতে ফিরছি সবাই, হোটেলের গেটের কাছে আসতেই পাশ থেকে স্থানীয় একজন নিচু গলায় বললো কাম ইন স্যার, ম্যান ফর ম্যান, লেডিস ফর লেডিস।

20100418_9999_64 বুঝতে কিছুক্ষণ সময় লাগলেও বুঝলাম ভদ্রলোক পাশের পা টেপা দোকানের। ব্যাংকক, বেইজিং এর মতন মালয়েশিয়ার টুরিস্ট স্পট গুলোতেও পা টেপা দোকানের অভাব নেই। কুয়ালালামপুরের দোকানগুলোর সামনে বড় বড় পোস্টার টানিয়ে পা টেপার বৈজ্ঞানিক দিক ব্যাখ্যা করে ক্রেতা আকর্ষণ করা হয়। আমরা পা টেপাটেপিতে না যেয়ে রঙ্গীন আলো গায়ে মেখে ঘুরতে ঘুরতে হোটেলে ঢুকে গেলাম।


প্রজাপতি আর লাভ লেন

বুকিং এর সময় দেখেছিলাম এ হোটেলের চেক আউট সময় সকাল দশটা, তাই তখনই বলে রেখেছিলাম আমরা বিকেল ৩টায় হোটেল ছাড়বো, এসময় টুরিস্ট কম বলে রাজি হয়েছিলো তখন। সকালে নাস্তা করে আমরা তাই চলে গেলাম প্রজাপতির বাগান দেখতে।

Butterflies from Penang প্রজাপতির বাগান এরা বলে তামান রামা-রামা।আমরা যে রাস্তায় বাটু ফিরিঙ্গি এসেছি সে পথ ধরে আরো ১০ কিমির মতন সামনে এই পার্ক। প্রায় আড়াই একরের এ বাগানে ওদের কথানুযায়ী ১২০ প্রজাতির ৪০০ ধরনের প্রজাপতির সংগ্রহ আছে।

Butterflies from Penang পার্কে ঢোকার মুখেই বানানো পাহাড়ে বসে থাকা বিশাল তিনশিঙা বিটল আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকেই প্রজাপতির ছোঁয়া পেলাম। নানান রঙ, আকৃতি আর ধরনের অগুনতি প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে, প্রত্যেকটাই আলাদা আলাদা সুন্দর। উড়ে এসে গায়ে বসে আবার চলে যায়। কিছু কিছু প্রজাপতি খুব শান্ত হয়ে বসলেও কয়েকটাকে একবারের জন্যও ক্যামেরার ফ্রেমে আনতে পারি নি ওদের ব্যস্ততার জন্য। ছোট্ট এ বাগানের বাড়তি আকর্ষণ এর ভেতরের মিনি জু আর পোকা মাকড়ের জাদুঘর। এছাড়াও স্যুভেনির শপ আর একটা আর্ট গ্যালারিও আছে। জু তে বিটল, শিংওয়ালা কচ্ছপ, স্করপিয়ন আর ড্রাগন দেখলাম। জাদুঘরটা আরো চমৎকার, বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা নানান জাতের পোকামাকড় আর সরীসৃপ বয়ামে রাখা। দু’ঘন্টার চমৎকার সময় কাটিয়ে বাটু ফিরিঙ্গিতে বেলা বারোটার আগেই ফিরে এলাম। রিতা আর মাতিসকে হোটেলে রেখে আমরা তিনজন চলে এলাম জর্জটাউনে।

20100419_9999_153 জর্জটাউনের আধুনিক ইতিহাস সিঙ্গাপুরের চাইতে পুরোনো। জর্জটাউনের জন্ম ১৭৮৬ সালে আর সিঙ্গাপুরে বৃটিশরা আসে ১৮১৯ সালে। তারও কিছুকাল পর বৃটিশরা এ দুটো অঞ্চলকে সিটি হিসাবে ঘোষণা করে। বৃটিশদের দখলে যাবার আগে এ দুটোই যথাক্রমে কেদারের সুলতান আর জোহরের সুলতানদের দখলে ছিলো। বৃটিশদের কাছে সে সময় সিঙ্গাপুরের চাইতে জর্জটাউনের গুরুত্ব অনেক বেশি ছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং এর পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানান মেরুকরণে জর্জটাউন সিঙ্গাপুরের কাছে তার অবস্থান হারায় এবং ২০০৮ সালে এর পুরোনো অঞ্চলগুলো ইউনেস্কো হেরিটেজ হিসাবে ঘোষিত হয়।

20100419_9999_131 স্থানীয় মুসলমান, ভারতীয় তামিল আর চাইনিজ বংশোদ্ভূতদের নিয়ে জর্জটাউন। হাতে সময় কম বলে স্বল্প সময়ে শুধুমাত্র দু একটা রাস্তা ঘুরে দেখা ছাড়া আর কিছুই হলো না। ছবি তোলার জন্য জর্জটাউনে কমপক্ষে দিন দুই থাকা উচিত।

এবারে ফেরার পালা

20100419_9999_2 বিকেল ৩টায় হোটেল ছেড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে ফিরতি যাত্রায় কুয়ালালামপুরে। এবারে রাস্তায় ভালোই বৃষ্টি পেয়েছিলাম। মাতিসের টুইন টাওয়ার দেখার শখ মিটিয়েছে অরূপ ওর বাসায় ফেরার পথে টুইন টাওয়ার ঘুরিয়ে এনে। রাতে গোছগাছ সেরে খুব ভোরে যখন অরূপ মাশীদের বাসা ছাড়লাম মাতিস তখন তার সেই চেনা ডায়লগ ছাড়লো “বাবা, আমরা কী আবার এখানে আসবো?” উত্তর দিতে পারি নি, আসলে এ উত্তর আমার জানা নেই।

শুক্রবার, জুন ০৪, ২০১০

মালয়েশিয়া...আ আ...আ......আ...

ভূমিকা

Matisse and Rita আমার ছেলের স্কুল ছুটি। আগের বার ছুটিতে মালয়েশিয়া ঘুরিয়ে আনার কথা থাকলেও হয়ে ওঠে নি, তাই এবারে ছেলের আবদারে বাতাস লেগেছে ওর মায়ের একই সময় ছুটি মিলে যাওয়াতে। যেই সেই ছুটি না, চাকরি ছেড়ে দিয়ে একেবারে আড়াইমাসের জন্য। সব যখন ঠিকঠাক খেয়াল করলাম ভিসার জন্য হাতে সময় নেই, এখানকার মালয়েশিয়ান এম্বেসি তিন দিন সময় নেয়, কিন্তু যাবার আগে হাতে সময় মাত্র দুই দিন। একদিনের ভেতর যদি না দেয় তাহলে ঠিক করেছি ভিসা ছাড়াই যাত্রা করব, ওরা এয়ারপোর্ট থেকে ভিসা দেয়, ভরসা সেটাই। আমাদের অবাক করে দিয়ে একদিনেই এম্বেসি থেকে মাল্টিপল এন্ট্রি দিয়ে দিলো। এপ্রিলের ১৩ তারিখ রাতে এয়ারপোর্ট চলে এলাম বুকিং ছাড়াই। চোখের সামনে দিয়ে একেক করে লাইনের সবাই ভেতরে চলে গেলে চেকিং স্টাফ হাসিমুখে আমাদের জানালো বেটার টুমরো। এমন হতে পারে ভেবে পার্কিং এ গাড়ি রেখে দিয়েছিলাম, কিছুক্ষণ গল্প করে পরেরদিন ফ্লাইটের অবস্থার খোঁজ নিয়ে ফেরার পথে বনানী পৌঁছানো মাত্র এয়ারপোর্ট থেকে ফোন “আপনারা দশ মিনিটের ভেতর আসতে পারবেন?” পারবো বলেই গাড়ি ঘুরিয়ে ছুটলাম আবারো এয়ারপোর্ট, যেয়ে শুনলাম বিমান টারমাক ছেড়ে উড়াল দেবার ঠিক আগেই ৫ জন অসুস্থ বোধ করাতেই আমাদের কপাল খুলেছে।

এই অসুস্থতার পেছনের খবর আসলে অন্যরকম। ইদানীং বাঙ্গালি লেবারদের মালয় ভিসা বন্ধ থাকাতে প্রায় সবাই ভিসিট বা টুরিষ্ট ভিসা কিংবা জাল ভিসায় কুয়ালালামপুর যায়। সেখানে এয়ারপোর্টে কাজ করে এমন দালালদের মাধ্যমে মালয় ইমিগ্রেশনের সহায়তায় একবার এয়ারপোর্ট পেরুতে পারলেই নিশ্চিত। ঢাকা থেকে দেরীতে ছাড়াতে ওদিককার ইমিগ্রেশন সেকশনের শিফট বদলীর গ্যাড়াকলে পরে যাবার ভয়েই এই অসুস্থতা।


একবছর পর আবারো

ভোরে এয়ারপোর্টে নামার আগেই বিমানের গেটে পরিচিত একজনের মাধ্যমে মোবাইল কার্ড পেলাম, ঢাকার তুলনায় সস্তা না হলেও ডিজিটাল যুগে এই মোবাইলের উপর আমাদের নির্ভরশীলতার বিপরীতে খরচটা গায়ে মাখার মতন না। ইমিগ্রেশন ছেড়ে বাইরে এসে অরূপকে খুঁজে নিলাম, সাথে সাথে মনে পড়লো ঠিক একবছর আগেও অরূপ এয়ারপোর্ট এসেছিলো আমাকে তুলে নিতে। সেবার ছিলাম একা।


তারার পাহাড়ে সোনালি মানব

আজ পহেলা বোশেখ। অরূপ মাশীদের দরজায় দেখলাম দেশি মুখোশের ছবি লাগানো। দুবছর আগেও প্রতি বছর পহেলা বোশেখের আগেরদিন চারুকলায় যেয়ে মুখোশের ছবি তুলতাম। জমতে জমতে কয়েক’শ মুখোশের ছবি জমিয়েছি। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে স্মৃতি হাতড়ে মুখোশগুলো দেখে নিলাম একবার। এরপর ঘুম।

ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম, মাতিসের চমৎকার কিছু পোট্রেট তুলে দিলো অরূপ। বিকেলের দিকে বের হয়ে ‘ইকিয়া’তে ঢুকেছিলাম, কত বড় যাবে না, সন্ধ্যার পর ওখান থেকে বের হবার সময় মনে হলো পুরোটা দেখা হয় নি। চলে এলাম বুকিত বিনতাং এ, মালয় ভাষায় বুকিত মানে পাহাড় আর বিনতাং হলো তারা। তারার পাহাড়ের এ এলাকাটা কুয়ালালামপুর শহরকেন্দ্রের কাছেই। সারাদিন ব্যস্ত থাকার পরও এর আসল রূপ খোলে মাঝরাতে। পর্যটক আকর্ষণের সমস্ত কিছুই এ এলাকাটা ঘিরে। সব ধরনের হোটেল খাবার দোকান আর শপিং মল কিংবা ফুটপাতের হকার, সবই মিলে এখানে।

বুকিত বিনতাং এর রাস্তাতেই দেখা পেলাম ‘গোল্ড ম্যানের’, কিছুদিন আগে অরূপের সারাদিনে করা চমৎকার কিছু কাজ দেখেছিলাম এ সোনালি মানবের উপর, এবারে সামনে থেকে দেখলাম। পাশাপাশি রুপালি মানবীরও সাক্ষাৎ মিললো। সারা শরীরে রঙ মেখে ভোর থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত পর্যটকদের আনন্দ দেয়। বিনিময়ে যা পায় তাতে সংসারের খরচ মেটে কি না কে জানে?


তামার খনি আর পাথরের গুহা

Green Lizard from Kualalumpur দ্বিতীয় দিন সকালে চলে এলাম সানওয়ে লেগুনে। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে কী থেকে কী বানানো যায় তার চমৎকার উদাহারণ এই লেগুন। একসময় এলাকাটা ছিলো তামার খনি, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তামা আর টিন তোলা হতো এখান থেকে। সেসব শেষ হলে পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিলো এলাকাটা, ৯২/৯৩ সালে প্রথম এ নিচু এলাকাটাতে ছোট্ট ওয়াটার পার্ক গড়ে তোলা হয়। এরপর ২০০৮ সালে এসে ৮০ একরের বর্তমান থিম পার্কের চেহারা নেয় সানওয়ে লেগুন এবং এর আশপাশ মিলে পুরো একটা পরিকল্পিত শহরের জন্ম নেয়।

20100415_9999_48 সারাদিন পানিতে দাপাদাপি করে কাটিয়েছি সানওয়েতে। এ পার্কে প্রচুর বাঙালি কাজ করেন। বেশির ভাগই পাশের সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এছাড়া কন্‌জারভেটর হিসাবেও আছেন কয়েকজন। এদেরই একজন বিভিন্ন পাখি আর সরিসৃপ ঘুরিয়ে দেখালেন, গলায় বার্মিজ অজগর পেঁচিয়ে ছবি তুলতেও সাহায্য করলেন।

Lord Murugan Statue এর পরদিন গেলাম বাটু কেভ দেখতে। বাটু কেভ অর্থ পাথরের গুহা। চুনাপাথরের এ পাহাড় ৪০কোটি বছরের পুরোনো বলে ধারণা করা হয়। বয়সের ভারে পাহাড়ের বিভিন্ন অংশ ধ্বসে পড়ে নানান আকৃতির গুহার সৃষ্টি হয়েছে। এর ভেতর সবচাইতে বড় যেটা মেঝে থেকে উপরের উচ্চতা ৩০০ ফুটের উপর। সিঙ্গাপুরে জন্ম নেয়া তামিল হিন্দু থাম্বুস্বামী কৃষ্ণ ১৮৯১ সালে এখানে তামিল হিন্দুদের যুদ্ধ দেবতা মুরুগানের (কার্তিকের পুত্র) মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।

২৭২টা সিঁড়ি পেরিয়ে মূল মন্দিরে যাওয়াটা অনেকের জন্য কষ্টকর হলেও প্রতি বছর প্রচুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে তামিলরা এখানে পূজা দিতে আসেন। জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসে থাইপুসাম উৎসবের সময় এটা মেলায় রূপ নেয়।

272 steps দুপুরের কড়া রোদে ঘামতে ঘামতে উপরে উঠে মূল গুহা ঘুরে দেখলাম। ছাদের ফাঁক ফোকর দিয়ে আলো এসে নিচের পাকা মেঝেতে পড়ছে। চারিদিকে বিভিন্ন আকৃতির ঝুলন্ত পাহাড়ের খাঁজ আলো আঁধারিতে অদ্ভুতাকার নিয়ে আছে, এর ভেতর বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। আর আছে বানর, অগণিত। দুয়েকটা দোকান, হালকা পানীয় আর পূজার জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো।




অবশেষে পেনাং যাচ্ছি

20100418_9999_11 এখানে যাবো না সেখানে যাবো এই করতে করতে কুয়ালালামপুরে তিন রাত কেটে গেল , এর মাঝে তামার খনি আর পাথরের গুহা ঘুরে এলেও পেনাং যাওয়ার ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছিলাম বারবার। সেখানে যাবার উদ্দেশ্য স্নোরক্লিং করা। বিদেশ বিভুঁইয়ে দুজন সাঁতার না জানাকে নিয়ে স্নোরক্লিং করাটা একটু সমস্যাই মনে হয়েছিলো আমার কাছে। যাওয়া হবে না ভেবে ছেলের কালো মুখ দেখেই হয়তো অরূপ ঠিক করে ফেললো আমাদের সাথে সেও পেনাং যাবে।

আর যায় কোথায়, আমরা এসেছি শুনে আগেরদিন থেকেই অরূপ-মাশীদদের ছোট্ট বাসায় বর্তমানে কুয়ালালামপুর প্রবাসী ফটোগ্রাফার অভীক আস্তানা গেড়েছে, কিছুটা ছন্নছাড়া অভীক পেনাং যাবার কথা শুনেই লাফিয়ে উঠে পেট খারাপের অজুহাত তুলে অফিস কামাই দিয়ে দল ভারী করলো আমাদের। ঠিক হলো পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অরূপের ছোট্ট গাড়িতে রওনা হব সবাই।


রক বনাম রবীন্দ্র সংগীত

পুলাউ পেনাং, স্থানীয় ভাষায় পুলাউ মানে দ্বীপ আর পেনাং মানে সুপারি। কুয়ালালামপুর থেকে উত্তরে এ দ্বীপ গাড়িতে চার/পাঁচ ঘন্টার পথ। কখনো সমতল কখনো পাহাড়ি বা বন কিংবা টানেলের ভেতর দিয়ে পুরো যাত্রা পথেই রাস্তার দুপাশের চিত্র প্রায়শই বদলে যেতে থাকে। আর সাথে যদি থাকে অভীকের মতন কেউ, ভ্রমণ তাতে কারো কাছে যন্ত্রণাদায়ক মনে হলেও একবার রক পরক্ষণেই রবীন্দ্র সংগীত শুনতে আমাদের অন্তত খারাপ লাগে নি মোটেই। গাড়ি চালাচ্ছিলো অরূপ, ঘন্টা খানিকের দূরত্বে থেকে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কোথায় যেনো ফোন করলো, কথা বার্তায় বুঝলাম স্নোরক্লিং এর টিকিট দেয় যে অফিস সেখানে ফোন করে বিকেল পাঁচটার পরও কিছুক্ষণ খোলা রেখে আমাদের অপেক্ষায় থাকতে বলছে সে। আমরা স্পষ্ট ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ শুনলাম “ওকে নো প্রব্লেম”।


সালাহ্‌ সাতু কারা

এর আধঘণ্টা পর পেনাং ব্রিজের উপর আমরা, ১৩ কিলোমিটার লম্বা ব্রিজটা মুলভূমির সাথে পেনাং কে যোগ করেছে সমুদ্রের উপর দিয়ে। দুপাশের দেয়ালের জন্য ব্রিজ থেকে সমুদ্র দেখার সৌন্দর্য অনেক কমে গেছে। ব্রিজ পেরিয়ে মূল দ্বীপে ঢুকে পড়লাম একসময়। দ্বীপটা মালয়েশিয়ার একটা রাজ্যও বটে, রাজধানী জর্জটাউন, পুরোনো এ শহরটির গুরুত্ব একসময় সিঙ্গাপুরের চাইতে বেশি ছিলো, যোগাযোগ আর সুরক্ষা সুবিধার জন্য বৃটিশরা আস্তে আস্তে সিঙ্গাপুরের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকলে জর্জটাউনের গুরুত্ব কমে যায়।

20100419_9999_167 ব্রিজ পেরিয়ে জর্জটাউনে যাবার রাস্তা ডানে ফেলে মোটামুটি পাহাড় ঘেঁষে গাড়ি চললো। কিছুক্ষণ পর খেয়াল হলো ঘুরে ফিরে রাস্তার নাম একই “সালাহ্‌ সাতু কারা”, এদিকে অরূপের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হেসে বললো এর অর্থ “একদিকে চলাচল”। আমরাও হেসে নিলাম। হাসতে হাসতেই পৌঁছে গেলাম স্নোরক্লিং এর টিকিট কেনার অফিসে। বিকেল পাঁচে বন্ধ হবার কথা থাকলেও আমরা আসবো বলে ছয়টাতেও খোলা ছিলো এর দরজা।