ভূমিকা
আমার ছেলের স্কুল ছুটি। আগের বার ছুটিতে মালয়েশিয়া ঘুরিয়ে আনার কথা থাকলেও হয়ে ওঠে নি, তাই এবারে ছেলের আবদারে বাতাস লেগেছে ওর মায়ের একই সময় ছুটি মিলে যাওয়াতে। যেই সেই ছুটি না, চাকরি ছেড়ে দিয়ে একেবারে আড়াইমাসের জন্য। সব যখন ঠিকঠাক খেয়াল করলাম ভিসার জন্য হাতে সময় নেই, এখানকার মালয়েশিয়ান এম্বেসি তিন দিন সময় নেয়, কিন্তু যাবার আগে হাতে সময় মাত্র দুই দিন। একদিনের ভেতর যদি না দেয় তাহলে ঠিক করেছি ভিসা ছাড়াই যাত্রা করব, ওরা এয়ারপোর্ট থেকে ভিসা দেয়, ভরসা সেটাই। আমাদের অবাক করে দিয়ে একদিনেই এম্বেসি থেকে মাল্টিপল এন্ট্রি দিয়ে দিলো। এপ্রিলের ১৩ তারিখ রাতে এয়ারপোর্ট চলে এলাম বুকিং ছাড়াই। চোখের সামনে দিয়ে একেক করে লাইনের সবাই ভেতরে চলে গেলে চেকিং স্টাফ হাসিমুখে আমাদের জানালো বেটার টুমরো। এমন হতে পারে ভেবে পার্কিং এ গাড়ি রেখে দিয়েছিলাম, কিছুক্ষণ গল্প করে পরেরদিন ফ্লাইটের অবস্থার খোঁজ নিয়ে ফেরার পথে বনানী পৌঁছানো মাত্র এয়ারপোর্ট থেকে ফোন “আপনারা দশ মিনিটের ভেতর আসতে পারবেন?” পারবো বলেই গাড়ি ঘুরিয়ে ছুটলাম আবারো এয়ারপোর্ট, যেয়ে শুনলাম বিমান টারমাক ছেড়ে উড়াল দেবার ঠিক আগেই ৫ জন অসুস্থ বোধ করাতেই আমাদের কপাল খুলেছে।
এই অসুস্থতার পেছনের খবর আসলে অন্যরকম। ইদানীং বাঙ্গালি লেবারদের মালয় ভিসা বন্ধ থাকাতে প্রায় সবাই ভিসিট বা টুরিষ্ট ভিসা কিংবা জাল ভিসায় কুয়ালালামপুর যায়। সেখানে এয়ারপোর্টে কাজ করে এমন দালালদের মাধ্যমে মালয় ইমিগ্রেশনের সহায়তায় একবার এয়ারপোর্ট পেরুতে পারলেই নিশ্চিত। ঢাকা থেকে দেরীতে ছাড়াতে ওদিককার ইমিগ্রেশন সেকশনের শিফট বদলীর গ্যাড়াকলে পরে যাবার ভয়েই এই অসুস্থতা।
একবছর পর আবারো
ভোরে এয়ারপোর্টে নামার আগেই বিমানের গেটে পরিচিত একজনের মাধ্যমে মোবাইল কার্ড পেলাম, ঢাকার তুলনায় সস্তা না হলেও ডিজিটাল যুগে এই মোবাইলের উপর আমাদের নির্ভরশীলতার বিপরীতে খরচটা গায়ে মাখার মতন না। ইমিগ্রেশন ছেড়ে বাইরে এসে অরূপকে খুঁজে নিলাম, সাথে সাথে মনে পড়লো ঠিক একবছর আগেও অরূপ এয়ারপোর্ট এসেছিলো আমাকে তুলে নিতে। সেবার ছিলাম একা।
তারার পাহাড়ে সোনালি মানব
আজ পহেলা বোশেখ। অরূপ মাশীদের দরজায় দেখলাম দেশি মুখোশের ছবি লাগানো। দুবছর আগেও প্রতি বছর পহেলা বোশেখের আগেরদিন চারুকলায় যেয়ে মুখোশের ছবি তুলতাম। জমতে জমতে কয়েক’শ মুখোশের ছবি জমিয়েছি। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে স্মৃতি হাতড়ে মুখোশগুলো দেখে নিলাম একবার। এরপর ঘুম।
ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম, মাতিসের চমৎকার কিছু পোট্রেট তুলে দিলো অরূপ। বিকেলের দিকে বের হয়ে ‘ইকিয়া’তে ঢুকেছিলাম, কত বড় যাবে না, সন্ধ্যার পর ওখান থেকে বের হবার সময় মনে হলো পুরোটা দেখা হয় নি। চলে এলাম বুকিত বিনতাং এ, মালয় ভাষায় বুকিত মানে পাহাড় আর বিনতাং হলো তারা। তারার পাহাড়ের এ এলাকাটা কুয়ালালামপুর শহরকেন্দ্রের কাছেই। সারাদিন ব্যস্ত থাকার পরও এর আসল রূপ খোলে মাঝরাতে। পর্যটক আকর্ষণের সমস্ত কিছুই এ এলাকাটা ঘিরে। সব ধরনের হোটেল খাবার দোকান আর শপিং মল কিংবা ফুটপাতের হকার, সবই মিলে এখানে।
বুকিত বিনতাং এর রাস্তাতেই দেখা পেলাম ‘গোল্ড ম্যানের’, কিছুদিন আগে অরূপের সারাদিনে করা চমৎকার কিছু কাজ দেখেছিলাম এ সোনালি মানবের উপর, এবারে সামনে থেকে দেখলাম। পাশাপাশি রুপালি মানবীরও সাক্ষাৎ মিললো। সারা শরীরে রঙ মেখে ভোর থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত পর্যটকদের আনন্দ দেয়। বিনিময়ে যা পায় তাতে সংসারের খরচ মেটে কি না কে জানে?
তামার খনি আর পাথরের গুহা
দ্বিতীয় দিন সকালে চলে এলাম সানওয়ে লেগুনে। সঠিক পরিকল্পনা থাকলে কী থেকে কী বানানো যায় তার চমৎকার উদাহারণ এই লেগুন। একসময় এলাকাটা ছিলো তামার খনি, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তামা আর টিন তোলা হতো এখান থেকে। সেসব শেষ হলে পরিত্যক্ত অবস্থাতেই ছিলো এলাকাটা, ৯২/৯৩ সালে প্রথম এ নিচু এলাকাটাতে ছোট্ট ওয়াটার পার্ক গড়ে তোলা হয়। এরপর ২০০৮ সালে এসে ৮০ একরের বর্তমান থিম পার্কের চেহারা নেয় সানওয়ে লেগুন এবং এর আশপাশ মিলে পুরো একটা পরিকল্পিত শহরের জন্ম নেয়।
সারাদিন পানিতে দাপাদাপি করে কাটিয়েছি সানওয়েতে। এ পার্কে প্রচুর বাঙালি কাজ করেন। বেশির ভাগই পাশের সানওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, এছাড়া কন্জারভেটর হিসাবেও আছেন কয়েকজন। এদেরই একজন বিভিন্ন পাখি আর সরিসৃপ ঘুরিয়ে দেখালেন, গলায় বার্মিজ অজগর পেঁচিয়ে ছবি তুলতেও সাহায্য করলেন।
এর পরদিন গেলাম বাটু কেভ দেখতে। বাটু কেভ অর্থ পাথরের গুহা। চুনাপাথরের এ পাহাড় ৪০কোটি বছরের পুরোনো বলে ধারণা করা হয়। বয়সের ভারে পাহাড়ের বিভিন্ন অংশ ধ্বসে পড়ে নানান আকৃতির গুহার সৃষ্টি হয়েছে। এর ভেতর সবচাইতে বড় যেটা মেঝে থেকে উপরের উচ্চতা ৩০০ ফুটের উপর। সিঙ্গাপুরে জন্ম নেয়া তামিল হিন্দু থাম্বুস্বামী কৃষ্ণ ১৮৯১ সালে এখানে তামিল হিন্দুদের যুদ্ধ দেবতা মুরুগানের (কার্তিকের পুত্র) মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।
২৭২টা সিঁড়ি পেরিয়ে মূল মন্দিরে যাওয়াটা অনেকের জন্য কষ্টকর হলেও প্রতি বছর প্রচুর হিন্দু ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে তামিলরা এখানে পূজা দিতে আসেন। জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসে থাইপুসাম উৎসবের সময় এটা মেলায় রূপ নেয়।
দুপুরের কড়া রোদে ঘামতে ঘামতে উপরে উঠে মূল গুহা ঘুরে দেখলাম। ছাদের ফাঁক ফোকর দিয়ে আলো এসে নিচের পাকা মেঝেতে পড়ছে। চারিদিকে বিভিন্ন আকৃতির ঝুলন্ত পাহাড়ের খাঁজ আলো আঁধারিতে অদ্ভুতাকার নিয়ে আছে, এর ভেতর বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি। আর আছে বানর, অগণিত। দুয়েকটা দোকান, হালকা পানীয় আর পূজার জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো।
অবশেষে পেনাং যাচ্ছি
এখানে যাবো না সেখানে যাবো এই করতে করতে কুয়ালালামপুরে তিন রাত কেটে গেল , এর মাঝে তামার খনি আর পাথরের গুহা ঘুরে এলেও পেনাং যাওয়ার ব্যাপারটা এড়িয়ে যাচ্ছিলাম বারবার। সেখানে যাবার উদ্দেশ্য স্নোরক্লিং করা। বিদেশ বিভুঁইয়ে দুজন সাঁতার না জানাকে নিয়ে স্নোরক্লিং করাটা একটু সমস্যাই মনে হয়েছিলো আমার কাছে। যাওয়া হবে না ভেবে ছেলের কালো মুখ দেখেই হয়তো অরূপ ঠিক করে ফেললো আমাদের সাথে সেও পেনাং যাবে।
আর যায় কোথায়, আমরা এসেছি শুনে আগেরদিন থেকেই অরূপ-মাশীদদের ছোট্ট বাসায় বর্তমানে কুয়ালালামপুর প্রবাসী ফটোগ্রাফার অভীক আস্তানা গেড়েছে, কিছুটা ছন্নছাড়া অভীক পেনাং যাবার কথা শুনেই লাফিয়ে উঠে পেট খারাপের অজুহাত তুলে অফিস কামাই দিয়ে দল ভারী করলো আমাদের। ঠিক হলো পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে অরূপের ছোট্ট গাড়িতে রওনা হব সবাই।
রক বনাম রবীন্দ্র সংগীত
পুলাউ পেনাং, স্থানীয় ভাষায় পুলাউ মানে দ্বীপ আর পেনাং মানে সুপারি। কুয়ালালামপুর থেকে উত্তরে এ দ্বীপ গাড়িতে চার/পাঁচ ঘন্টার পথ। কখনো সমতল কখনো পাহাড়ি বা বন কিংবা টানেলের ভেতর দিয়ে পুরো যাত্রা পথেই রাস্তার দুপাশের চিত্র প্রায়শই বদলে যেতে থাকে। আর সাথে যদি থাকে অভীকের মতন কেউ, ভ্রমণ তাতে কারো কাছে যন্ত্রণাদায়ক মনে হলেও একবার রক পরক্ষণেই রবীন্দ্র সংগীত শুনতে আমাদের অন্তত খারাপ লাগে নি মোটেই। গাড়ি চালাচ্ছিলো অরূপ, ঘন্টা খানিকের দূরত্বে থেকে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে কোথায় যেনো ফোন করলো, কথা বার্তায় বুঝলাম স্নোরক্লিং এর টিকিট দেয় যে অফিস সেখানে ফোন করে বিকেল পাঁচটার পরও কিছুক্ষণ খোলা রেখে আমাদের অপেক্ষায় থাকতে বলছে সে। আমরা স্পষ্ট ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ শুনলাম “ওকে নো প্রব্লেম”।
সালাহ্ সাতু কারা
এর আধঘণ্টা পর পেনাং ব্রিজের উপর আমরা, ১৩ কিলোমিটার লম্বা ব্রিজটা মুলভূমির সাথে পেনাং কে যোগ করেছে সমুদ্রের উপর দিয়ে। দুপাশের দেয়ালের জন্য ব্রিজ থেকে সমুদ্র দেখার সৌন্দর্য অনেক কমে গেছে। ব্রিজ পেরিয়ে মূল দ্বীপে ঢুকে পড়লাম একসময়। দ্বীপটা মালয়েশিয়ার একটা রাজ্যও বটে, রাজধানী জর্জটাউন, পুরোনো এ শহরটির গুরুত্ব একসময় সিঙ্গাপুরের চাইতে বেশি ছিলো, যোগাযোগ আর সুরক্ষা সুবিধার জন্য বৃটিশরা আস্তে আস্তে সিঙ্গাপুরের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকলে জর্জটাউনের গুরুত্ব কমে যায়।
ব্রিজ পেরিয়ে জর্জটাউনে যাবার রাস্তা ডানে ফেলে মোটামুটি পাহাড় ঘেঁষে গাড়ি চললো। কিছুক্ষণ পর খেয়াল হলো ঘুরে ফিরে রাস্তার নাম একই “সালাহ্ সাতু কারা”, এদিকে অরূপের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হেসে বললো এর অর্থ “একদিকে চলাচল”। আমরাও হেসে নিলাম। হাসতে হাসতেই পৌঁছে গেলাম স্নোরক্লিং এর টিকিট কেনার অফিসে। বিকেল পাঁচে বন্ধ হবার কথা থাকলেও আমরা আসবো বলে ছয়টাতেও খোলা ছিলো এর দরজা।
শুক্রবার, জুন ০৪, ২০১০
মালয়েশিয়া...আ আ...আ......আ...
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন