যাত্রা পর্ব।
প্রথম ধ্বাক্কাটা খেলাম উত্তরার শেষ প্রান্তে মাস্কট প্লাজার মোড়টা পেরুতেই। পেছনে ডান দিকে ঘষা লাগিয়ে দিলো ময়মনসিংহ গামী বাস। মিররে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। এদিকে জ্যাম সবে মাত্র লাগতে শুরু করেছে। বন্ধের সময় সকাল আটে অত গাড়ী ঘোড়া রাস্তায় না থাকারই কথা। ভাবলাম টঙ্গী ব্রীজ পেরুলেই রাস্তা খালি, আরামে চলে যেতে পারবো। আমার ধারণা মিথ্যে প্রমানিত হলো কিছুক্ষণের ভেতরই।চারদিকে শুধু গাড়ী আর গাড়ী, ছোট বড় যাত্রীবাহী গাড়ীর সাথে যুক্ত হয়েছে ট্রাক। সেই ট্রাকেরই আবার নানান কিসিম, কেউ মেঝেতে ত্রিপল বিছিয়েছে কেউবা তোষক। এরই মাঝে চারদিক থেকে ঝুলে ঝুলে মানুষ উঠছে। দূর্বল বিশেষ করে মহিলাদের টেনে টেনে তোলা হচ্ছে ট্রাকের উপর। উপরে উঠতে পারার বা বাড়িতে যেতে পারার সূরাহা হবার আনন্দ তাদের চোখে মুখে। টাংগাইল ছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলায় পৌঁছার প্রধান সড়ক এটাই। সেসব রুটের বাস ছাড়াও বাড়তি কামানোর ধান্ধায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন রুটের বাসও চলছে আগাপাশতলা মানুষে বোঝাই হয়ে সে সব গন্তব্যে। কত মানুষ ঢাকা ছাড়ে ঈদে? গাড়ী চলছেনা। মাঝে মাঝে থেমে থাকতে হচ্ছে, এমনও হয়েছে প্রায় ঘন্টা খানিক চুপচাপ বসে আছি, এরপর একটু এগোয়, আবার থামে, আবার এগোয়। গাড়ীতে রেডিয়ো ছেড়ে রেখেছি, চার ঘন্টার এক এপিসোডে থেমে থেমে ক্যান্সারে আক্রান্ত কবি কাজী রোজীর সাক্ষাৎকার শুনলাম। ভদ্র মহিলা পনেরো বছরের উপর ক্যান্সারের সাথে লড়াই চালাচ্ছেন। গাড়ীতে আমি, রিতা আর মাতিস ছাড়াও আছে মাতিসের বন্ধু সাদ্। ওরা থাকে নিকেতনে আমাদের উপরের তলায়। সাদের বাবা পাকিস্তানী, বছর আটেক আগে করাচীতে ছুরীর আঘাতে মারা যান, সাদের তখন মাত্র জন্ম হয়েছে। ঘুমানোর আর স্কুলের সময়টুকু ছাড়া প্রায় পুরোটা সময় আমাদের বাসাতেই থাকে। ঢাকার ভেতর কোথাও বেড়াতে গেলে মাতিসের সাথে সাদ থাকবেই, এবারের ঈদে বাড়ী যাবার আগের দিন সাদ কে বলার সাথে সাথে রাজী, ওর মাকেও দেখলাম সানন্দে রাজী হতে, সাথে সাথে ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন। সাদের জন্য ঢাকা ছাড়া এই প্রথম, চারদিকে প্রবল উৎসূক্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। সবই অসাধারণ লাগছে ওর কাছে। বাস ট্রাকের উপর থেকে গলা বের করে বমি করা দেখতেও তাদের আনন্দ লাগে।ঠিক করেছিলাম তিন সাড়ে তিন ঘন্টা যাই সময় লাগুক বাড়ী পৌঁছেই নাস্তা করবো, গাড়িতে বিস্কিট আছে, ক্ষুধা লাগলে বাচ্চারা খেয়ে নেবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এসে বাড়ীতে ফোন করে জানানো হলো আমরা হয়তো দুপুরের খাবারের সময় এসে পৌঁছাবো। আমার সে ধারণাও সঠিক ছিলোনা, জয়দেবপুরের মোড় যখন পেরিয়েছি বেলা সেসময় দেড়টা, ৩২কিমি রাস্তা পেরুতে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার উপর লেগেছে, কল্পনারও বাইরে। এর মাঝে গাড়ীতে ঘষা লেগেছে মোট পাঁচবার। শেষবার ঠিক জয়দেবপুর মোড়টা পেরুবার আগে আগেই। ঠিক করেছিলাম এযাত্রায় মেজাজগরম করবোনা। শেষ বারে তা আর ধরে রাখতে পারিনি।আমার জীবনে যতবার ঢাকা থেকে বাড়ী গিয়েছি তার মাঝে দীর্ঘতম সময় যাত্রার সাড়ে নয় ঘন্টা পর যখন বাড়ীর গেট পেরুলাম সূর্য ততক্ষণে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।ঢাকার তুলনায় ময়মনসিংহে ঠান্ডা বেশী,হঠাৎ করেই কনকনে বাতাস গায়ে লাগা শুরু হলো, আব্বা জ্যাকেট বের করে দিলেন উনার। প্রতিবারের মত আমরা আড্ডায় বসে গেলাম, বাড়ির বউরা রান্না বান্নায়, আগামীকাল ঈদ।
এক।
ঢাকায় স্কুল ছুটি থাকলে মাতিস সাধারণত দেরী করেই বিছানা ছাড়ে, ঈদের দিন সকাল সাতটার আগে ওকে বিছানা ছাড়তে দেখে তাই অবাকই হলাম। আমাদের তিন ভাই দেশের বাইরে থাকায় ওরা ছাড়া বাকি পাঁচ জন পরিবার সহ বাড়িতে। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়। সারা বছর খালি পড়ে থাকলেও ঈদের সময় বাড়ি গিজগিজ করে। এদিকে বাড়িতে গিজার লাগানো গোসলখানা একটাই, সাদ আর মাতিসকে গোসল দিয়ে যখন নাস্তা করাতে বসেছি ঘড়িতে আটটা বাজেনি সেসময়। নাস্তার পর ওদের নিয়ে গেলাম বাড়ীর পেছনে। সেখানে প্রথমেই পুকুর, শীত বলে পানি কম, বাঁশ ঝাড় আর সেগুন মেহগিনির বাগান। সে বাগানের পাশে ধানী জমি, তাতে পাকা ধান সোনালী হয়ে আছে। ধান ক্ষেত পেরুলেই বন। ওরা সবাই মেতে উঠলো খেলায়। একবার পুকুরের উঁচু পাড় বেয়ে উঠে আর একবার ধান ক্ষেতের ভেতর দৌড়ে বেড়ায়। সাদকে দেখলাম কিছু ধান ছিড়ে পকেটে ভরতে, ঢাকায় ফিরে মাকে দেখাবে।
দুই।
ঠিক দশটায় ঈদ্গায়। শীতের দিন, কুয়াশা তখনও কাটেনি। এবারে জামাতে লোক সমাগম কম। কারনটা বুঝলামনা। আমাদের গ্রামে কোরবানীর নিয়মটা একটু অন্যরকম। সবাই যার যার কোরবানী নামাজের পর মাঠে নিয়ে আসে, সেখানেই কোরবানী দিয়ে ভাগের মাংস রেখে বাকিটা বাড়ি আনা হয়। এরপর সবার রেখে আসা মাংস একত্র করে গ্রামের সব পরিবারকে সমান ভাগ করে দেওয়া হয়। এছাড়াও বাড়িতে নিয়ে আসা মাংস থেকেও অনেকে গরীবদের দিয়ে থাকে। ব্যবস্থাটা একদিক থেকে ভালোই। এবারে গরু জবাইয়ের সময় আমি কাছাকাছি ছিলামনা, সময় কাটিয়েছি বাড়িতে, বাচ্চাদের সাথে।
তিন।
দুপুরের আগে বাচ্চারা আবদার ধরলো ওরা শিকারে যাবে, কিভাবে যেন টের পেয়েছে বাড়িতে বন্দুক আছে। সেইমত বন্দুক হাতে দলবেঁধে পেছনের বাগানে। বন্দুকের ভার বইতে না পারলেও একেকজনের টার্গেট প্র্যাক্টিসের বিরাম নেই। সেনাবাহিনীতে থাকা আমার এক ছোট ভাই ওদের ইন্সট্রাক্টর, বাড়ির মেয়েরাও আবার বাদ যাবে কেন? ওরাও এসে জুটলো টার্গেট প্র্যাকটিসে। বাচ্চাদের সাথে মিশে আমরাও কিছুক্ষণের জন্য বয়সটা ভুলে গেলাম। ফিরে গেলাম শৈশবে। বাড়ির পেছন থেকে শুরু করে বন পর্যন্ত বেশ ক’বার দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ফিরে খেতে বসলাম সবাই।
চার।
দুপুরের পর একটু আলসেমী মত লাগলেও উঠে পড়লাম, পরদিনই ঢাকা ফিরবো, হাতে সময় কম, একবার বড়ই বাগানটা দেখে না এলে কেমন হয়। সখের বাগান। পাঁচ একরের বিশাল বাগানের গাছ গুলো দেখতে দেখতে বড় হয়ে গিয়েছে। এবারে ধরেছেও প্রচুর। পাতা আর ফল আলাদা করাই মুশকিল। মাস খানিক পর থেকেই খাবার উপযুক্ত হবে। গতবার ফলনের দাম পাওয়া যায়নি। খেয়াল করে দেখেছি যেকোন সব্জী বা ফল ঢাকায় যে দামে খুচরা বিক্রি হয় খামারে পাইকারী বিক্রি হয় তার তিন ভাগের একভাগ দামে, কোন কোন ক্ষেত্রে তারও কম। আমার পাশের বাগানের কাঁচামরিচ পাইকারী বিক্রি হতে দেখলাম প্রতি ৪০কেজি ৪৭৫টাকা দরে! বাগানে পৌঁছানো মাত্রই বাচ্চারা মেতে উঠলো খেলাতে।
পাঁচ।
সবশেষে আসুন আমাদের বাড়ির নুতন অতিথির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, আশা করি আগামীবছর এই সময় তাকেও অন্যদের সাথে খেলায় মেতে উঠতে দেখা যাবে।
শনিবার, ডিসেম্বর ০৫, ২০০৯
ঈদ ছবির গল্প
তাৎক্ষণিক নভেম্বর ২৫, ২০০৯
১।
গতকাল হঠাৎ করে মাস্টার্সের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন পড়লো। সার্টিফিকেটানুযায়ী আমার মাস্টার্স পাশের বছর ১৯৮৪, যদিও সামরিক শাসনের জন্য অনির্ধারিত বন্ধে আমরা চুড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েছিলাম ‘৮৭তে। ২৫ বছর যাবৎ এই সার্টিফিকেট ছাড়াই জীবন পেরিয়ে এলেও এখন এটা খুঁজতে যেয়ে জান বেরোবার উপক্রম। মনে আছে ৮৯’র দিকে ইউনিভার্সিটি থেকে সার্টিফিকেট তুলেছিলাম এবং সে বছরই কোন এক এরশাদ ভ্যাকেশনে মহসিন হলে পুলিশি তান্ডবে রুমে রাখা আমার সার্টিফিকেট গুলো অন্যান্য জিনিষপত্রের সাথে হারিয়ে গিয়েছিলো পেয়েছিলাম শুধু একটা ফটোকপি। এতদিন পর প্রায় পাঁচ ঘন্টা তন্নতন্ন করে খুঁজে অনেক কাগজের মাঝে অবশেষে সেই ফটোকপি হাতে পেয়েছি। আজ আবার ইউনিভার্সিটি দৌড়াতে হবে এটার মূল কপি তুলতে।
২।
আমাদের বাসায় জিনিষপত্র এমনিতেই কম। তারপরেও খুঁজে পেতে দেরী হবার কারন ভিন্ন। মাঝে মাঝে বিশেষ কিছু জিনিষ যেমন কার্ড, বই, ছবি, ক্যাটালগ ইত্যাদি কিছুদিন পর দেখবো বলে জমিয়ে রাখতাম এবং যথারীতি ভুলেও যেতাম। গতকাল তেমন একটা বই হাতে পেয়ে অনেক্ষণ ধরে দেখলাম। ২০০২ সালের দিকে একটা ব্যাংকের অর্থানুকুল্যে ডঃ নওয়াজেশ আহ্মেদের তোলা ছবি আর রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের লাইন নিয়ে ছবির বই বেরোয়েছিলো। মনে পড়ে সীমিত ছাপা (১০০০কপি) এই বইটি সেই ব্যাংকের সেরা গ্রাহকদের মাঝে বিনামূল্যে দেয়া হয়েছিলো। ২০০৫ এর দিকে একবার আমার ছোট ভায়ের অফিসে যেয়ে বইটি দেখে নিয়ে এসেছিলাম এবং যথারীতি ভুলেও গিয়েছিলাম। গতরাত প্রায় দুইটা পর্যন্ত বইয়ের ছবিগুলো দেখলাম। প্রায় ছবিই পদ্মার আশেপাশে তোলা। কিছুদিন আগে ডঃ আহ্মেদের সাথে আড্ডায় উনি আবারো পদ্মায় সময় কাটানোর কথা বলেছিলেন, জানিয়েছিলেন উনি ডিজিটাল ক্যামেরা কিনবেন যদি আমরা উনার সাথে পদ্মায় যাই। বলেছিলাম এটা আমাদের মত যে কারো জন্যে ভাগ্যের ব্যাপার হবে যদি উনার সাথে ছবি তোলা নিয়ে কিছুদিন কাটাতে পারি। বইটা দেখতে দেখতে ঠিক করলাম আজকেই উনার সাথে যোগাযোগ করবো এব্যাপারে। আমার দূর্ভাগ্য আমি জানতামনা যখন উনার তোলা ছবিগুলো দেখছি সেসময় উনি সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন।
৩।
আমাদের বাসা থেকে আমার অফিস প্রায় নয় কিমি। এটুকু রাস্তার প্রথম দেড় কিমি পেরুতে আধ ঘন্টার উপর সময় লাগে, আজ লেগেছে পাক্কা ৪৫মিনিট। প্রতিবছর কোরবানীর ঈদে বাড়ি যাই, সাধারণত ঈদের আগের দিন, এবারেও হয়তো তার ব্যতীক্রম হবেনা, সব ঠিক থাকলে আগামী শুক্রবার ঢাকা ছাড়বো। ফিরে আসবো ঈদের পরদিন। ইদানীং ঢাকা ছাড়া খুব ঝামেলার। ১৬০কিমি দূরে বাড়ীতে যেতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার অর্ধেক সময় লাগে ঢাকা ছাড়তে। ঈদের আগে এখনই ঢাকার যে অবস্থা তাতে পাঁচ ঘন্টায় যেতে পারলেও স্বস্তি।
৪।
প্রতিবছরের মত এবারেও আমাদের অফিসের ক্যালেন্ডার ছাপাতে দিয়েছি, আগামী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বিতরন শুরু করবো, গতবছর এসময় উত্তরায় এক মেগা সচলাড্ডায় বেশ কিছু ক্যালেন্ডার পাঠিয়েছিলাম বিতরনের জন্য, সেদিন সিলেট থেকে ফিরছিলাম, মনে আছে বিডিআর আর নজরুল ভাই বার বার ফোনে খোঁজ নিচ্ছিলেন কতদূর এসেছি, শেষ পর্যন্ত যদিও যাওয়া হয়নি সেখানে। আজ হঠাৎ মনে হলো এবারেও কী তেমন এক বিশাল সচলাড্ডার আয়োজন করা যায়না?
৫।
এবারে একটু অন্যরকম খবর। গেটি ইমেজের নাম অনেকেই শুনেছেন। অনেকদিন যাবৎই ওরা আমার ছবি চাচ্ছিলো বিক্রি করার জন্য। গেটিতে ছবি দেয়ার নানা ঝামেলা, কপিরাইটের কারনে ওরা এমন এমন কাগজপত্র চায় তাতে মনে হয় সেখানে ছবি দেয়া হয়তো কোনদিন হবেনা। এরমাঝে একটামাত্র পাঠিয়েছিলাম, সেদিন দেখি ওরা চেক পাঠিয়ে দিয়েছে ডাকে। সেই চেক আমাদের দেশের অনেক নিয়ম কানুনের বেড়াজালে পড়ে এখনও জমা দেয়া হয়নি। আদৌ হবে কীনা সেটাও বলতে পারিনা। ছবিটা দেখুন, তিওমানে বেড়াতে যেয়ে G9 ক্যামেরায় তোলা।
বৃহস্পতিবার, নভেম্বর ০৫, ২০০৯
'এলাট' সুন্দরবন
ভয়, উৎকন্ঠা, সাহস আর রোমাঞ্চপ্রিয়তার এক চুড়ান্ত ঘটনার কথা আজ শুনাবো আপনাদের। সুন্দরবনের হিরনপয়েন্ট পুরো বনএলাকার বনেদী অঞ্চলগুলোর অন্যতম। ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২৫ মাইল পূবে সুন্দরবনের দক্ষিণে হিরনপয়েন্টে ফরেস্ট অফিস ছাড়াও মংলা পোর্টের শাখা অফিস আর নৌবাহিনীর ডেরা আছে সেখানে। ফরেস্ট অফিসের উত্তরে নদীর ঠিক ওপারে বনটার নাম কেওড়াশুটি, সম্ভবত প্রচুর কেওড়া গাছ আছে বলেই। চারদিকে নদীঘেরা পূবে পশ্চিমে দুমাইল আর উত্তর দক্ষিণে আধামাইলের কিছু বেশী জায়গাটা গুগুলে খুঁটিয়ে দেখতে যেয়ে কিছু বিশেষত্ব খুঁজে পেলাম। যেমন ধরেন, এর মাঝখানে একটা অংশে গাছপালার পরিমান কিছুটা কম, ভেতরে একটা মিঠা পানির পুকুরের মতন আছে এসব। যার সবগুলোই আসলে প্রমান করে ভেতরে প্রচুর হরিনের অবস্থান আর অবধারিত ভাবেই বাঘের উপস্থিতি। ট্যুর কোম্পানীগুলো এসব স্থান এড়িয়ে চলে, এমনকি আমাদের বাপ্পিদাও প্রথম প্রথম নিমরাজি ছিলেন। আমাদের, বিশেষ করে আমার অটল সিদ্বান্তের কারনেই শেষপর্যন্ত এবারের সুন্দরবনযাত্রার প্রথম ভোরে নাস্তা সারবার আগেই ঘন্টা দুয়েকের জন্য ভেতরে এ জায়গায় যাবার অনুমতি দিলেন। আমার বেশ ক’বার বনযাত্রায় যত জায়গা দেখেছি আর যত ছবি তুলেছি তার ভেতরে সবচাইতে সুন্দর যায়গা আর ছবিগুলো এখানকারই।
সেখান থেকে ফিরে এসে সিদ্বান্ত নিলাম দুবলারচরে অবস্থানের সময় কমিয়ে এনে পরদিন বিকেলে আবারো এ জায়গাটাতে আরেকটু বেশী সময় কাটিয়ে যাবো। দুবলারচর থেকে তাই মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগেই দুপুরের দিকে হিরনপয়েন্টের দিকে ফিরতি যাত্রা করলাম। ততক্ষণে ভাটা নেমে এসেছে। হিরনপয়েন্টের প্রায় দুকিলোমিটার দূরে থাকতেই পানির অস্বাভাবিক কমে যাওয়া খেয়াল করছিলাম, আরেকটু কাছে আসতেই আমাদের ট্রলার বালুতে আটকে গেল। নীচের ঢেউ দেখে বোঝার উপায় নেই যে পানি এখানে মাত্র দু / আড়াইফিট। হিসাব করে দেখলাম পরবর্তী জোয়ার আসতে আসতে আরো প্রায় তিন ঘন্টা লাগবে, তাই নেমে গেলাম পানিতে। হিরনপয়েন্টের ওপারের জায়গাটায় হেঁটে যেতে হলে গলা পানি ভাংতে হবে। তাতে সময় বেশী লাগবে আর ক্যামেরাও ভিজে যেতে পারে সেই চিন্তায় নুতন প্ল্যান করলাম। আমরা যেখানে নেমেছি সেখান থেকে সোজা হেঁটে ভেজা বালুর চর পেরিয়ে অল্প একটু কেওড়া আর গর্জনের বন পেরুলেই পৌঁছে যাবো ঐ তিন অফিসের পেছনের ঘন ছন গাছে ছাওয়া বিশাল মাঠের কিনারে। সেখান থেকে মাঠের মাঝদিয়ে ছোট্ট একটা মিঠাপানির জলার পাশদিয়ে পরিত্যাক্ত হেলিপেড পাড়ি দিলেই ছোট্ট মাটির রাস্তা বেয়ে ফরেস্ট অফিসের পুকুর। ঘুরতে ঘুরতে ছবি তুলতে তুলতে সেখানে পৌঁছাতে আড়াইঘন্টার বেশী লাগবার কথা নয়। আমরা পাঁচ সহযাত্রী বনের কাছাকাছি আসতেই রাইফেল হাতে এমদাদ আর রেজাউল নেমে এলেন। পানিতে নেমেছিলাম বলে সবার পা খালি। বনের কাছাকাছি বালুতে ছোট ছোট ঘাস, পায়ে কাটার মত বিঁধে। এরমাঝে শ্বাসমূল, এগুলোর খোঁচাও পায়ে লাগে। অনেকদূর যেতে হবে এই কষ্ট গায়ে মেখে। আমাদের দুজন তাই নৌকায় ফিরে গেলো। আমরা হাঁটছি সাবধানে। খুবকাছে দিয়ে হরিণ ছুটে যায়, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, ছবি তুলি একটা দুটো। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বনের প্রান্তে। এমদাদ আরেকপ্রস্থ বনের নিয়ম স্মরণ করিয়ে দিলো সবাইকে। সমূহ বিপদের কথা মাথায় রেখে রেজাউল তার রাইফেল তৈরী রাখলো। কেওড়া বনে হালকা পানি, কাদাও আছে। আমার সামনে এমদাদ, পেছনে অন্যরা, সবশেষে রেজাউল। এমদাদ যেখানে পা ফেলে আমিও সেখানে, তাতে কাঁটা ফোটার সম্ভাবনা কম। একশ মিটার পেরোতে আধঘন্টা পেরিয়ে গেলো, সামনে হাতদশেক জুড়ে কাঁটা গাছ আর ঘাস, হাতখানিক লম্বা, অবশেষে ছনে ঢাকা মাঠ। ডানদিকে পোর্ট অফিসের দোতলার ছাঁদ দেখা যায়। উপরদিকে তাকালে টাওয়ার। দুদিন আগেও ছন বাগানের ওদিকটাতে এসেছিলাম একবার, সেদিকে ছেঁটে ফেলায় ছন গাছ দেখাচ্ছিলো ঘাসের মতন। কিন্তু এদিকে ছনের আগা মাথা ছুঁয়ে যায়। কয়েকপা এগিয়ে ডাকলাম ‘এমদাদ’। আমার দিকে ঘুরে মনের কথা পড়ে ফেললো সে। বললো, ‘ঠিকই বস্, এখান দিয়ে যাওয়া নিরাপদ না’। হিরনপয়েন্ট এলেও এমদাদ এদিকে আসেনি। আমার গুগুল জ্ঞান আর এমদাদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে ঠিক করলাম ছনের বন আর কাঁটা গাছের পাশদিয়ে পশ্চিমে হেঁটে মিঠা পানির জায়গাটার পাশদিয়ে পরিত্যাক্ত হেলিপ্যাড দিয়ে উত্তরে উঠবো আমরা। সে অনূযায়ী ঘুরে বেড়িয়ে এলাম, রেজাউল সহ আমাদের একজন তখনও কাঁটা গাছ পেরোচ্ছে পায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে। আমার আরেক সহযাত্রী বললো ‘সামনে হরিণ পাওয়া যেতে পারে, টেলি লেন্সটা লাগিয়ে নিই’। সামনে হাতপাঁচেক দূরে কয়েকহাত খোলা জায়গার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম ‘সেখানে যেয়ে করেন’। সেখানে পৌঁছে যেইনা সে নিচু হয়েছে অমনি রক্ত হিম করা ভয়ঙ্কর সে ডাক। আমাদের বামে দশহাতের ভেতর একদেড় হাত উঁচু কাঁটা আর ঘাসের ভেতর থেকে।
মূহুর্তের ভেতর অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেলো একসাথে। এমদাদ ‘এলাট’ বলে (এলার্ট নয়) চিৎকার দিয়ে রাইফেল কক্ করে হাটু ভেঙ্গে বামে তাক করে বসলো। আমার বামহাতে ক্যামেরা বামদিকেই তাক করা ছিলো, তাতে ডান হাতের চাপে ছবি উঠলো, আমার পাশের জন একহাতে ক্যামেরা আর অন্য হাতে লেন্স নিয়ে চট করে বসে গেলো। পেছনের দুজন কাছাকাছি ঘেসে দাঁড়ালো আর রেজাউলের রাইফেল নিরবে ঘুরে গেলো শব্দের উৎসের দিকে। কি যেনো দেখলাম মনে হয় নড়ে উঠলো, এরপর চারদিক নিঃশব্দ, কোন আওয়াজ নেই কোথাও। বাতাসও মনে হলো থেমে আছে, শুধু শব্দের উৎসের কাছে ছোট একটা কাঁটা গাছ আস্তে আস্তে দুলতে দুলতে থেমে গেলো। নিরবতা ভেঙ্গে এমদাদ বলে উঠলো চলে গেছে, তাড়াতাড়ি হাঁটেন। ক্যামেরার স্ক্রীনে তাকালাম, দশহাত দূরে গোলপাতা আর সামনে কিছু কাঁটা গাছ আর ঘাসের ছবি। সামনের মাটিতে টাটকা পায়ের ছাপ অভিজ্ঞ এমদাদের চোখ বলে পূর্নবয়স্ক পুরুষ বাঘ এটি, উচ্চতা সাড়েতিন ফুটের কাছাকাছি। অথচ এত ছোট ঘাসের মাঝে নিজেকে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছিলো আমাদের কারো চোখে পড়েনি।
আর কোন সমস্যা ছাড়াই চলে এলাম ফরেস্ট অফিসে, ছন বনের জলায় মাছ ধরতে থাকা পোর্টের দুজনও চলে এলো আমাদের পিছুপিছু।
...............
স্থানীয় সবাই অভিজ্ঞতার পুরো বিবরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনার পর ঘটনার আকার দাঁড়িয়েছে এরকম...
বালুর মাঠ থেকে বনে আমাদের ঢুকতে দেখে বাঘ আক্রমনের সিদ্বান্ত নেয়। কাউকে বা কিছু আক্রমন করতে গেলে বাঘ অনেক্ষণ ধরে সেটা অনুসরণ করে আচার আচরন খেয়াল করে এরপর আক্রমনের স্থান নির্ধারন করে ওৎ পেতে থাকে। আমরা যখন বনে আস্তে আস্তে হাঁটছি সেসময় সে আমাদের আচরন খেয়াল করে টার্গেট ঠিক করে সেখানে ওৎ পেতে ছিলো। কোন কারনে টার্গেটের অস্বাভাবিক কোন আচরনে বাঘ, বিশেষত রয়েল বেঙ্গল টাইগার তার আক্রমনের সিদ্বান্ত পরিবর্তন করে।
আমাদের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে তিনটি বিষয়, প্রথমত বনে আমরা আস্তে হেঁটেছি কিন্তু বন পেরিয়ে একটু জোরে, দ্বিতীয়ত একবার ঘন উঁচু ছনবনে ঢুকেও আমাদের বেরিয়ে আসা, তৃতীয় কারনটা আমার সাথে থাকা ক্যামেরার লেন্স বদলাতে যাওয়া সহযাত্রী, বেশীরভাগের ধারনা বাঘের টার্গেট ছিলো সে এবং বাঘ লাফ দেবার চুড়ান্ত মুহুর্তে সে লেন্স বদলাতে যেয়ে বসে যাওয়াতেই বাঘ হালকা গর্জন করে বিরক্তি প্রকাশ করে সরে গেয়েছে। তাদের মতামত বাঘ যদি আক্রমনের মুডে না থাকতো তাহলে এত বড় বাঘ অবশ্যই আমাদের নজরে আসতো।