পর্যটক হিসাবে সুন্দরবনে গিয়ে বাঘের দেখা পেয়েছেন তেমন লোক হাতে গোনা যাবে। আর খপ্পরে পড়েছেন? নাহ্, আমি অন্তত তেমন কিছু শুনিনি কোনদিন। তবে, যতবার গিয়েছি আশেপাশের কেউ তার শিকার হয়েছেন সেকথা শুনেছি প্রতিবার। কখনও লাশ ফিরিয়ে আনা গেছে, কখনও পাওয়া যায়নি। এই যেমন, এবারে তিন জনকে বাঘে ধরার খবর শুনেছি, তিনটাই ছিলো টাটকা। দুজনের লাশ ফিরিয়ে আনা গেছে আর একজনকে আহত অবস্থায়। একটা করে খবর আসে আর আমাদের বাপ্পিদা ফোনে সংবাদ পাঠান, পরদিনের দৈনিকে টাটকা খবর হিসাবে। শেষেরটা ছিলো ভয়াবহ। গামছায় ভরে ছিন্নভিন্ন দেহ বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সেই ট্রলার এসেছে মাঝনদীতে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে আটকে থাকা আমাদের উদ্ধার করতে, ট্রলারের মাঝির লাশদেখে বমি করে দেবার দাগটুকু মোছার আগেই।এবারের ঘোরাঘুরিটা এরকম অনেক কারনেই মনে দাগ কেটে থাকবে আজীবন। গিয়েছিলাম দুবলার চরের রাসমেলা দেখতে। কত শুনেছি এই রাসমেলার কথা। অথচ সেখানে পৌঁছে পূজার আগেই ফিরে এসেছি আশাহত হয়ে। আসলে সুন্দরবন দেখতে হলে সুন্দরবনে থাকাই ভালো।প্রচলিত ধারার ট্যূর কোম্পানীর সাথে বেড়াতে যেয়ে সুন্দরবনের মজা কতটুকু পাওয়া যায়, তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে আমার। মানে আরাম পাইনি কোনদিন। অনেক নিয়মের বেড়াজালে নৌকা ভ্রমনটাইপের একটা ব্যাপার ঘটে সেখানে। তাই গুগুল ম্যাপের কল্যানে প্রতিবারই নুতন জায়গা খুঁজে বের করে সেদিকে ঘুরে আসার ভেতর যে রোমাঞ্চ, তার প্রতি আগ্রহটাই বেশি আমার।
ভয়, উৎকন্ঠা, সাহস আর রোমাঞ্চপ্রিয়তার এক চুড়ান্ত ঘটনার কথা আজ শুনাবো আপনাদের। সুন্দরবনের হিরনপয়েন্ট পুরো বনএলাকার বনেদী অঞ্চলগুলোর অন্যতম। ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২৫ মাইল পূবে সুন্দরবনের দক্ষিণে হিরনপয়েন্টে ফরেস্ট অফিস ছাড়াও মংলা পোর্টের শাখা অফিস আর নৌবাহিনীর ডেরা আছে সেখানে। ফরেস্ট অফিসের উত্তরে নদীর ঠিক ওপারে বনটার নাম কেওড়াশুটি, সম্ভবত প্রচুর কেওড়া গাছ আছে বলেই। চারদিকে নদীঘেরা পূবে পশ্চিমে দুমাইল আর উত্তর দক্ষিণে আধামাইলের কিছু বেশী জায়গাটা গুগুলে খুঁটিয়ে দেখতে যেয়ে কিছু বিশেষত্ব খুঁজে পেলাম। যেমন ধরেন, এর মাঝখানে একটা অংশে গাছপালার পরিমান কিছুটা কম, ভেতরে একটা মিঠা পানির পুকুরের মতন আছে এসব। যার সবগুলোই আসলে প্রমান করে ভেতরে প্রচুর হরিনের অবস্থান আর অবধারিত ভাবেই বাঘের উপস্থিতি। ট্যুর কোম্পানীগুলো এসব স্থান এড়িয়ে চলে, এমনকি আমাদের বাপ্পিদাও প্রথম প্রথম নিমরাজি ছিলেন। আমাদের, বিশেষ করে আমার অটল সিদ্বান্তের কারনেই শেষপর্যন্ত এবারের সুন্দরবনযাত্রার প্রথম ভোরে নাস্তা সারবার আগেই ঘন্টা দুয়েকের জন্য ভেতরে এ জায়গায় যাবার অনুমতি দিলেন। আমার বেশ ক’বার বনযাত্রায় যত জায়গা দেখেছি আর যত ছবি তুলেছি তার ভেতরে সবচাইতে সুন্দর যায়গা আর ছবিগুলো এখানকারই।
সেখান থেকে ফিরে এসে সিদ্বান্ত নিলাম দুবলারচরে অবস্থানের সময় কমিয়ে এনে পরদিন বিকেলে আবারো এ জায়গাটাতে আরেকটু বেশী সময় কাটিয়ে যাবো। দুবলারচর থেকে তাই মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগেই দুপুরের দিকে হিরনপয়েন্টের দিকে ফিরতি যাত্রা করলাম। ততক্ষণে ভাটা নেমে এসেছে। হিরনপয়েন্টের প্রায় দুকিলোমিটার দূরে থাকতেই পানির অস্বাভাবিক কমে যাওয়া খেয়াল করছিলাম, আরেকটু কাছে আসতেই আমাদের ট্রলার বালুতে আটকে গেল। নীচের ঢেউ দেখে বোঝার উপায় নেই যে পানি এখানে মাত্র দু / আড়াইফিট। হিসাব করে দেখলাম পরবর্তী জোয়ার আসতে আসতে আরো প্রায় তিন ঘন্টা লাগবে, তাই নেমে গেলাম পানিতে। হিরনপয়েন্টের ওপারের জায়গাটায় হেঁটে যেতে হলে গলা পানি ভাংতে হবে। তাতে সময় বেশী লাগবে আর ক্যামেরাও ভিজে যেতে পারে সেই চিন্তায় নুতন প্ল্যান করলাম। আমরা যেখানে নেমেছি সেখান থেকে সোজা হেঁটে ভেজা বালুর চর পেরিয়ে অল্প একটু কেওড়া আর গর্জনের বন পেরুলেই পৌঁছে যাবো ঐ তিন অফিসের পেছনের ঘন ছন গাছে ছাওয়া বিশাল মাঠের কিনারে। সেখান থেকে মাঠের মাঝদিয়ে ছোট্ট একটা মিঠাপানির জলার পাশদিয়ে পরিত্যাক্ত হেলিপেড পাড়ি দিলেই ছোট্ট মাটির রাস্তা বেয়ে ফরেস্ট অফিসের পুকুর। ঘুরতে ঘুরতে ছবি তুলতে তুলতে সেখানে পৌঁছাতে আড়াইঘন্টার বেশী লাগবার কথা নয়। আমরা পাঁচ সহযাত্রী বনের কাছাকাছি আসতেই রাইফেল হাতে এমদাদ আর রেজাউল নেমে এলেন। পানিতে নেমেছিলাম বলে সবার পা খালি। বনের কাছাকাছি বালুতে ছোট ছোট ঘাস, পায়ে কাটার মত বিঁধে। এরমাঝে শ্বাসমূল, এগুলোর খোঁচাও পায়ে লাগে। অনেকদূর যেতে হবে এই কষ্ট গায়ে মেখে। আমাদের দুজন তাই নৌকায় ফিরে গেলো। আমরা হাঁটছি সাবধানে। খুবকাছে দিয়ে হরিণ ছুটে যায়, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, ছবি তুলি একটা দুটো। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বনের প্রান্তে। এমদাদ আরেকপ্রস্থ বনের নিয়ম স্মরণ করিয়ে দিলো সবাইকে। সমূহ বিপদের কথা মাথায় রেখে রেজাউল তার রাইফেল তৈরী রাখলো। কেওড়া বনে হালকা পানি, কাদাও আছে। আমার সামনে এমদাদ, পেছনে অন্যরা, সবশেষে রেজাউল। এমদাদ যেখানে পা ফেলে আমিও সেখানে, তাতে কাঁটা ফোটার সম্ভাবনা কম। একশ মিটার পেরোতে আধঘন্টা পেরিয়ে গেলো, সামনে হাতদশেক জুড়ে কাঁটা গাছ আর ঘাস, হাতখানিক লম্বা, অবশেষে ছনে ঢাকা মাঠ। ডানদিকে পোর্ট অফিসের দোতলার ছাঁদ দেখা যায়। উপরদিকে তাকালে টাওয়ার। দুদিন আগেও ছন বাগানের ওদিকটাতে এসেছিলাম একবার, সেদিকে ছেঁটে ফেলায় ছন গাছ দেখাচ্ছিলো ঘাসের মতন। কিন্তু এদিকে ছনের আগা মাথা ছুঁয়ে যায়। কয়েকপা এগিয়ে ডাকলাম ‘এমদাদ’। আমার দিকে ঘুরে মনের কথা পড়ে ফেললো সে। বললো, ‘ঠিকই বস্, এখান দিয়ে যাওয়া নিরাপদ না’। হিরনপয়েন্ট এলেও এমদাদ এদিকে আসেনি। আমার গুগুল জ্ঞান আর এমদাদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে ঠিক করলাম ছনের বন আর কাঁটা গাছের পাশদিয়ে পশ্চিমে হেঁটে মিঠা পানির জায়গাটার পাশদিয়ে পরিত্যাক্ত হেলিপ্যাড দিয়ে উত্তরে উঠবো আমরা। সে অনূযায়ী ঘুরে বেড়িয়ে এলাম, রেজাউল সহ আমাদের একজন তখনও কাঁটা গাছ পেরোচ্ছে পায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে। আমার আরেক সহযাত্রী বললো ‘সামনে হরিণ পাওয়া যেতে পারে, টেলি লেন্সটা লাগিয়ে নিই’। সামনে হাতপাঁচেক দূরে কয়েকহাত খোলা জায়গার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম ‘সেখানে যেয়ে করেন’। সেখানে পৌঁছে যেইনা সে নিচু হয়েছে অমনি রক্ত হিম করা ভয়ঙ্কর সে ডাক। আমাদের বামে দশহাতের ভেতর একদেড় হাত উঁচু কাঁটা আর ঘাসের ভেতর থেকে।
মূহুর্তের ভেতর অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেলো একসাথে। এমদাদ ‘এলাট’ বলে (এলার্ট নয়) চিৎকার দিয়ে রাইফেল কক্ করে হাটু ভেঙ্গে বামে তাক করে বসলো। আমার বামহাতে ক্যামেরা বামদিকেই তাক করা ছিলো, তাতে ডান হাতের চাপে ছবি উঠলো, আমার পাশের জন একহাতে ক্যামেরা আর অন্য হাতে লেন্স নিয়ে চট করে বসে গেলো। পেছনের দুজন কাছাকাছি ঘেসে দাঁড়ালো আর রেজাউলের রাইফেল নিরবে ঘুরে গেলো শব্দের উৎসের দিকে। কি যেনো দেখলাম মনে হয় নড়ে উঠলো, এরপর চারদিক নিঃশব্দ, কোন আওয়াজ নেই কোথাও। বাতাসও মনে হলো থেমে আছে, শুধু শব্দের উৎসের কাছে ছোট একটা কাঁটা গাছ আস্তে আস্তে দুলতে দুলতে থেমে গেলো। নিরবতা ভেঙ্গে এমদাদ বলে উঠলো চলে গেছে, তাড়াতাড়ি হাঁটেন। ক্যামেরার স্ক্রীনে তাকালাম, দশহাত দূরে গোলপাতা আর সামনে কিছু কাঁটা গাছ আর ঘাসের ছবি। সামনের মাটিতে টাটকা পায়ের ছাপ অভিজ্ঞ এমদাদের চোখ বলে পূর্নবয়স্ক পুরুষ বাঘ এটি, উচ্চতা সাড়েতিন ফুটের কাছাকাছি। অথচ এত ছোট ঘাসের মাঝে নিজেকে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছিলো আমাদের কারো চোখে পড়েনি।
আর কোন সমস্যা ছাড়াই চলে এলাম ফরেস্ট অফিসে, ছন বনের জলায় মাছ ধরতে থাকা পোর্টের দুজনও চলে এলো আমাদের পিছুপিছু।
...............
স্থানীয় সবাই অভিজ্ঞতার পুরো বিবরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনার পর ঘটনার আকার দাঁড়িয়েছে এরকম...
বালুর মাঠ থেকে বনে আমাদের ঢুকতে দেখে বাঘ আক্রমনের সিদ্বান্ত নেয়। কাউকে বা কিছু আক্রমন করতে গেলে বাঘ অনেক্ষণ ধরে সেটা অনুসরণ করে আচার আচরন খেয়াল করে এরপর আক্রমনের স্থান নির্ধারন করে ওৎ পেতে থাকে। আমরা যখন বনে আস্তে আস্তে হাঁটছি সেসময় সে আমাদের আচরন খেয়াল করে টার্গেট ঠিক করে সেখানে ওৎ পেতে ছিলো। কোন কারনে টার্গেটের অস্বাভাবিক কোন আচরনে বাঘ, বিশেষত রয়েল বেঙ্গল টাইগার তার আক্রমনের সিদ্বান্ত পরিবর্তন করে।
আমাদের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে তিনটি বিষয়, প্রথমত বনে আমরা আস্তে হেঁটেছি কিন্তু বন পেরিয়ে একটু জোরে, দ্বিতীয়ত একবার ঘন উঁচু ছনবনে ঢুকেও আমাদের বেরিয়ে আসা, তৃতীয় কারনটা আমার সাথে থাকা ক্যামেরার লেন্স বদলাতে যাওয়া সহযাত্রী, বেশীরভাগের ধারনা বাঘের টার্গেট ছিলো সে এবং বাঘ লাফ দেবার চুড়ান্ত মুহুর্তে সে লেন্স বদলাতে যেয়ে বসে যাওয়াতেই বাঘ হালকা গর্জন করে বিরক্তি প্রকাশ করে সরে গেয়েছে। তাদের মতামত বাঘ যদি আক্রমনের মুডে না থাকতো তাহলে এত বড় বাঘ অবশ্যই আমাদের নজরে আসতো।
ভয়, উৎকন্ঠা, সাহস আর রোমাঞ্চপ্রিয়তার এক চুড়ান্ত ঘটনার কথা আজ শুনাবো আপনাদের। সুন্দরবনের হিরনপয়েন্ট পুরো বনএলাকার বনেদী অঞ্চলগুলোর অন্যতম। ভারতীয় সীমান্ত থেকে ২৫ মাইল পূবে সুন্দরবনের দক্ষিণে হিরনপয়েন্টে ফরেস্ট অফিস ছাড়াও মংলা পোর্টের শাখা অফিস আর নৌবাহিনীর ডেরা আছে সেখানে। ফরেস্ট অফিসের উত্তরে নদীর ঠিক ওপারে বনটার নাম কেওড়াশুটি, সম্ভবত প্রচুর কেওড়া গাছ আছে বলেই। চারদিকে নদীঘেরা পূবে পশ্চিমে দুমাইল আর উত্তর দক্ষিণে আধামাইলের কিছু বেশী জায়গাটা গুগুলে খুঁটিয়ে দেখতে যেয়ে কিছু বিশেষত্ব খুঁজে পেলাম। যেমন ধরেন, এর মাঝখানে একটা অংশে গাছপালার পরিমান কিছুটা কম, ভেতরে একটা মিঠা পানির পুকুরের মতন আছে এসব। যার সবগুলোই আসলে প্রমান করে ভেতরে প্রচুর হরিনের অবস্থান আর অবধারিত ভাবেই বাঘের উপস্থিতি। ট্যুর কোম্পানীগুলো এসব স্থান এড়িয়ে চলে, এমনকি আমাদের বাপ্পিদাও প্রথম প্রথম নিমরাজি ছিলেন। আমাদের, বিশেষ করে আমার অটল সিদ্বান্তের কারনেই শেষপর্যন্ত এবারের সুন্দরবনযাত্রার প্রথম ভোরে নাস্তা সারবার আগেই ঘন্টা দুয়েকের জন্য ভেতরে এ জায়গায় যাবার অনুমতি দিলেন। আমার বেশ ক’বার বনযাত্রায় যত জায়গা দেখেছি আর যত ছবি তুলেছি তার ভেতরে সবচাইতে সুন্দর যায়গা আর ছবিগুলো এখানকারই।
সেখান থেকে ফিরে এসে সিদ্বান্ত নিলাম দুবলারচরে অবস্থানের সময় কমিয়ে এনে পরদিন বিকেলে আবারো এ জায়গাটাতে আরেকটু বেশী সময় কাটিয়ে যাবো। দুবলারচর থেকে তাই মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগেই দুপুরের দিকে হিরনপয়েন্টের দিকে ফিরতি যাত্রা করলাম। ততক্ষণে ভাটা নেমে এসেছে। হিরনপয়েন্টের প্রায় দুকিলোমিটার দূরে থাকতেই পানির অস্বাভাবিক কমে যাওয়া খেয়াল করছিলাম, আরেকটু কাছে আসতেই আমাদের ট্রলার বালুতে আটকে গেল। নীচের ঢেউ দেখে বোঝার উপায় নেই যে পানি এখানে মাত্র দু / আড়াইফিট। হিসাব করে দেখলাম পরবর্তী জোয়ার আসতে আসতে আরো প্রায় তিন ঘন্টা লাগবে, তাই নেমে গেলাম পানিতে। হিরনপয়েন্টের ওপারের জায়গাটায় হেঁটে যেতে হলে গলা পানি ভাংতে হবে। তাতে সময় বেশী লাগবে আর ক্যামেরাও ভিজে যেতে পারে সেই চিন্তায় নুতন প্ল্যান করলাম। আমরা যেখানে নেমেছি সেখান থেকে সোজা হেঁটে ভেজা বালুর চর পেরিয়ে অল্প একটু কেওড়া আর গর্জনের বন পেরুলেই পৌঁছে যাবো ঐ তিন অফিসের পেছনের ঘন ছন গাছে ছাওয়া বিশাল মাঠের কিনারে। সেখান থেকে মাঠের মাঝদিয়ে ছোট্ট একটা মিঠাপানির জলার পাশদিয়ে পরিত্যাক্ত হেলিপেড পাড়ি দিলেই ছোট্ট মাটির রাস্তা বেয়ে ফরেস্ট অফিসের পুকুর। ঘুরতে ঘুরতে ছবি তুলতে তুলতে সেখানে পৌঁছাতে আড়াইঘন্টার বেশী লাগবার কথা নয়। আমরা পাঁচ সহযাত্রী বনের কাছাকাছি আসতেই রাইফেল হাতে এমদাদ আর রেজাউল নেমে এলেন। পানিতে নেমেছিলাম বলে সবার পা খালি। বনের কাছাকাছি বালুতে ছোট ছোট ঘাস, পায়ে কাটার মত বিঁধে। এরমাঝে শ্বাসমূল, এগুলোর খোঁচাও পায়ে লাগে। অনেকদূর যেতে হবে এই কষ্ট গায়ে মেখে। আমাদের দুজন তাই নৌকায় ফিরে গেলো। আমরা হাঁটছি সাবধানে। খুবকাছে দিয়ে হরিণ ছুটে যায়, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, ছবি তুলি একটা দুটো। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম বনের প্রান্তে। এমদাদ আরেকপ্রস্থ বনের নিয়ম স্মরণ করিয়ে দিলো সবাইকে। সমূহ বিপদের কথা মাথায় রেখে রেজাউল তার রাইফেল তৈরী রাখলো। কেওড়া বনে হালকা পানি, কাদাও আছে। আমার সামনে এমদাদ, পেছনে অন্যরা, সবশেষে রেজাউল। এমদাদ যেখানে পা ফেলে আমিও সেখানে, তাতে কাঁটা ফোটার সম্ভাবনা কম। একশ মিটার পেরোতে আধঘন্টা পেরিয়ে গেলো, সামনে হাতদশেক জুড়ে কাঁটা গাছ আর ঘাস, হাতখানিক লম্বা, অবশেষে ছনে ঢাকা মাঠ। ডানদিকে পোর্ট অফিসের দোতলার ছাঁদ দেখা যায়। উপরদিকে তাকালে টাওয়ার। দুদিন আগেও ছন বাগানের ওদিকটাতে এসেছিলাম একবার, সেদিকে ছেঁটে ফেলায় ছন গাছ দেখাচ্ছিলো ঘাসের মতন। কিন্তু এদিকে ছনের আগা মাথা ছুঁয়ে যায়। কয়েকপা এগিয়ে ডাকলাম ‘এমদাদ’। আমার দিকে ঘুরে মনের কথা পড়ে ফেললো সে। বললো, ‘ঠিকই বস্, এখান দিয়ে যাওয়া নিরাপদ না’। হিরনপয়েন্ট এলেও এমদাদ এদিকে আসেনি। আমার গুগুল জ্ঞান আর এমদাদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে ঠিক করলাম ছনের বন আর কাঁটা গাছের পাশদিয়ে পশ্চিমে হেঁটে মিঠা পানির জায়গাটার পাশদিয়ে পরিত্যাক্ত হেলিপ্যাড দিয়ে উত্তরে উঠবো আমরা। সে অনূযায়ী ঘুরে বেড়িয়ে এলাম, রেজাউল সহ আমাদের একজন তখনও কাঁটা গাছ পেরোচ্ছে পায়ে কাঁটা বিঁধিয়ে। আমার আরেক সহযাত্রী বললো ‘সামনে হরিণ পাওয়া যেতে পারে, টেলি লেন্সটা লাগিয়ে নিই’। সামনে হাতপাঁচেক দূরে কয়েকহাত খোলা জায়গার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম ‘সেখানে যেয়ে করেন’। সেখানে পৌঁছে যেইনা সে নিচু হয়েছে অমনি রক্ত হিম করা ভয়ঙ্কর সে ডাক। আমাদের বামে দশহাতের ভেতর একদেড় হাত উঁচু কাঁটা আর ঘাসের ভেতর থেকে।
মূহুর্তের ভেতর অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেলো একসাথে। এমদাদ ‘এলাট’ বলে (এলার্ট নয়) চিৎকার দিয়ে রাইফেল কক্ করে হাটু ভেঙ্গে বামে তাক করে বসলো। আমার বামহাতে ক্যামেরা বামদিকেই তাক করা ছিলো, তাতে ডান হাতের চাপে ছবি উঠলো, আমার পাশের জন একহাতে ক্যামেরা আর অন্য হাতে লেন্স নিয়ে চট করে বসে গেলো। পেছনের দুজন কাছাকাছি ঘেসে দাঁড়ালো আর রেজাউলের রাইফেল নিরবে ঘুরে গেলো শব্দের উৎসের দিকে। কি যেনো দেখলাম মনে হয় নড়ে উঠলো, এরপর চারদিক নিঃশব্দ, কোন আওয়াজ নেই কোথাও। বাতাসও মনে হলো থেমে আছে, শুধু শব্দের উৎসের কাছে ছোট একটা কাঁটা গাছ আস্তে আস্তে দুলতে দুলতে থেমে গেলো। নিরবতা ভেঙ্গে এমদাদ বলে উঠলো চলে গেছে, তাড়াতাড়ি হাঁটেন। ক্যামেরার স্ক্রীনে তাকালাম, দশহাত দূরে গোলপাতা আর সামনে কিছু কাঁটা গাছ আর ঘাসের ছবি। সামনের মাটিতে টাটকা পায়ের ছাপ অভিজ্ঞ এমদাদের চোখ বলে পূর্নবয়স্ক পুরুষ বাঘ এটি, উচ্চতা সাড়েতিন ফুটের কাছাকাছি। অথচ এত ছোট ঘাসের মাঝে নিজেকে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছিলো আমাদের কারো চোখে পড়েনি।
আর কোন সমস্যা ছাড়াই চলে এলাম ফরেস্ট অফিসে, ছন বনের জলায় মাছ ধরতে থাকা পোর্টের দুজনও চলে এলো আমাদের পিছুপিছু।
...............
স্থানীয় সবাই অভিজ্ঞতার পুরো বিবরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শোনার পর ঘটনার আকার দাঁড়িয়েছে এরকম...
বালুর মাঠ থেকে বনে আমাদের ঢুকতে দেখে বাঘ আক্রমনের সিদ্বান্ত নেয়। কাউকে বা কিছু আক্রমন করতে গেলে বাঘ অনেক্ষণ ধরে সেটা অনুসরণ করে আচার আচরন খেয়াল করে এরপর আক্রমনের স্থান নির্ধারন করে ওৎ পেতে থাকে। আমরা যখন বনে আস্তে আস্তে হাঁটছি সেসময় সে আমাদের আচরন খেয়াল করে টার্গেট ঠিক করে সেখানে ওৎ পেতে ছিলো। কোন কারনে টার্গেটের অস্বাভাবিক কোন আচরনে বাঘ, বিশেষত রয়েল বেঙ্গল টাইগার তার আক্রমনের সিদ্বান্ত পরিবর্তন করে।
আমাদের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে তিনটি বিষয়, প্রথমত বনে আমরা আস্তে হেঁটেছি কিন্তু বন পেরিয়ে একটু জোরে, দ্বিতীয়ত একবার ঘন উঁচু ছনবনে ঢুকেও আমাদের বেরিয়ে আসা, তৃতীয় কারনটা আমার সাথে থাকা ক্যামেরার লেন্স বদলাতে যাওয়া সহযাত্রী, বেশীরভাগের ধারনা বাঘের টার্গেট ছিলো সে এবং বাঘ লাফ দেবার চুড়ান্ত মুহুর্তে সে লেন্স বদলাতে যেয়ে বসে যাওয়াতেই বাঘ হালকা গর্জন করে বিরক্তি প্রকাশ করে সরে গেয়েছে। তাদের মতামত বাঘ যদি আক্রমনের মুডে না থাকতো তাহলে এত বড় বাঘ অবশ্যই আমাদের নজরে আসতো।
aami baakruddho!! amar shorirer lom ekhono dariye achhe......
উত্তরমুছুনerokom adventure kora amar pokkhe sombhob na.... aami har manlam..... apnader sathe ghure amar etai mone hoyeche je aami apnader sathe jabar joggota rakhi na..... you live in a different league of your own...... my respect!!
khub vhalo laglo bishesh kore chobi gulo live mone hocce
উত্তরমুছুন