যাত্রা পর্ব।
প্রথম ধ্বাক্কাটা খেলাম উত্তরার শেষ প্রান্তে মাস্কট প্লাজার মোড়টা পেরুতেই। পেছনে ডান দিকে ঘষা লাগিয়ে দিলো ময়মনসিংহ গামী বাস। মিররে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। এদিকে জ্যাম সবে মাত্র লাগতে শুরু করেছে। বন্ধের সময় সকাল আটে অত গাড়ী ঘোড়া রাস্তায় না থাকারই কথা। ভাবলাম টঙ্গী ব্রীজ পেরুলেই রাস্তা খালি, আরামে চলে যেতে পারবো। আমার ধারণা মিথ্যে প্রমানিত হলো কিছুক্ষণের ভেতরই।চারদিকে শুধু গাড়ী আর গাড়ী, ছোট বড় যাত্রীবাহী গাড়ীর সাথে যুক্ত হয়েছে ট্রাক। সেই ট্রাকেরই আবার নানান কিসিম, কেউ মেঝেতে ত্রিপল বিছিয়েছে কেউবা তোষক। এরই মাঝে চারদিক থেকে ঝুলে ঝুলে মানুষ উঠছে। দূর্বল বিশেষ করে মহিলাদের টেনে টেনে তোলা হচ্ছে ট্রাকের উপর। উপরে উঠতে পারার বা বাড়িতে যেতে পারার সূরাহা হবার আনন্দ তাদের চোখে মুখে। টাংগাইল ছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলায় পৌঁছার প্রধান সড়ক এটাই। সেসব রুটের বাস ছাড়াও বাড়তি কামানোর ধান্ধায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন রুটের বাসও চলছে আগাপাশতলা মানুষে বোঝাই হয়ে সে সব গন্তব্যে। কত মানুষ ঢাকা ছাড়ে ঈদে? গাড়ী চলছেনা। মাঝে মাঝে থেমে থাকতে হচ্ছে, এমনও হয়েছে প্রায় ঘন্টা খানিক চুপচাপ বসে আছি, এরপর একটু এগোয়, আবার থামে, আবার এগোয়। গাড়ীতে রেডিয়ো ছেড়ে রেখেছি, চার ঘন্টার এক এপিসোডে থেমে থেমে ক্যান্সারে আক্রান্ত কবি কাজী রোজীর সাক্ষাৎকার শুনলাম। ভদ্র মহিলা পনেরো বছরের উপর ক্যান্সারের সাথে লড়াই চালাচ্ছেন। গাড়ীতে আমি, রিতা আর মাতিস ছাড়াও আছে মাতিসের বন্ধু সাদ্। ওরা থাকে নিকেতনে আমাদের উপরের তলায়। সাদের বাবা পাকিস্তানী, বছর আটেক আগে করাচীতে ছুরীর আঘাতে মারা যান, সাদের তখন মাত্র জন্ম হয়েছে। ঘুমানোর আর স্কুলের সময়টুকু ছাড়া প্রায় পুরোটা সময় আমাদের বাসাতেই থাকে। ঢাকার ভেতর কোথাও বেড়াতে গেলে মাতিসের সাথে সাদ থাকবেই, এবারের ঈদে বাড়ী যাবার আগের দিন সাদ কে বলার সাথে সাথে রাজী, ওর মাকেও দেখলাম সানন্দে রাজী হতে, সাথে সাথে ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন। সাদের জন্য ঢাকা ছাড়া এই প্রথম, চারদিকে প্রবল উৎসূক্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। সবই অসাধারণ লাগছে ওর কাছে। বাস ট্রাকের উপর থেকে গলা বের করে বমি করা দেখতেও তাদের আনন্দ লাগে।ঠিক করেছিলাম তিন সাড়ে তিন ঘন্টা যাই সময় লাগুক বাড়ী পৌঁছেই নাস্তা করবো, গাড়িতে বিস্কিট আছে, ক্ষুধা লাগলে বাচ্চারা খেয়ে নেবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এসে বাড়ীতে ফোন করে জানানো হলো আমরা হয়তো দুপুরের খাবারের সময় এসে পৌঁছাবো। আমার সে ধারণাও সঠিক ছিলোনা, জয়দেবপুরের মোড় যখন পেরিয়েছি বেলা সেসময় দেড়টা, ৩২কিমি রাস্তা পেরুতে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার উপর লেগেছে, কল্পনারও বাইরে। এর মাঝে গাড়ীতে ঘষা লেগেছে মোট পাঁচবার। শেষবার ঠিক জয়দেবপুর মোড়টা পেরুবার আগে আগেই। ঠিক করেছিলাম এযাত্রায় মেজাজগরম করবোনা। শেষ বারে তা আর ধরে রাখতে পারিনি।আমার জীবনে যতবার ঢাকা থেকে বাড়ী গিয়েছি তার মাঝে দীর্ঘতম সময় যাত্রার সাড়ে নয় ঘন্টা পর যখন বাড়ীর গেট পেরুলাম সূর্য ততক্ষণে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।ঢাকার তুলনায় ময়মনসিংহে ঠান্ডা বেশী,হঠাৎ করেই কনকনে বাতাস গায়ে লাগা শুরু হলো, আব্বা জ্যাকেট বের করে দিলেন উনার। প্রতিবারের মত আমরা আড্ডায় বসে গেলাম, বাড়ির বউরা রান্না বান্নায়, আগামীকাল ঈদ।
এক।
ঢাকায় স্কুল ছুটি থাকলে মাতিস সাধারণত দেরী করেই বিছানা ছাড়ে, ঈদের দিন সকাল সাতটার আগে ওকে বিছানা ছাড়তে দেখে তাই অবাকই হলাম। আমাদের তিন ভাই দেশের বাইরে থাকায় ওরা ছাড়া বাকি পাঁচ জন পরিবার সহ বাড়িতে। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়। সারা বছর খালি পড়ে থাকলেও ঈদের সময় বাড়ি গিজগিজ করে। এদিকে বাড়িতে গিজার লাগানো গোসলখানা একটাই, সাদ আর মাতিসকে গোসল দিয়ে যখন নাস্তা করাতে বসেছি ঘড়িতে আটটা বাজেনি সেসময়। নাস্তার পর ওদের নিয়ে গেলাম বাড়ীর পেছনে। সেখানে প্রথমেই পুকুর, শীত বলে পানি কম, বাঁশ ঝাড় আর সেগুন মেহগিনির বাগান। সে বাগানের পাশে ধানী জমি, তাতে পাকা ধান সোনালী হয়ে আছে। ধান ক্ষেত পেরুলেই বন। ওরা সবাই মেতে উঠলো খেলায়। একবার পুকুরের উঁচু পাড় বেয়ে উঠে আর একবার ধান ক্ষেতের ভেতর দৌড়ে বেড়ায়। সাদকে দেখলাম কিছু ধান ছিড়ে পকেটে ভরতে, ঢাকায় ফিরে মাকে দেখাবে।
দুই।
ঠিক দশটায় ঈদ্গায়। শীতের দিন, কুয়াশা তখনও কাটেনি। এবারে জামাতে লোক সমাগম কম। কারনটা বুঝলামনা। আমাদের গ্রামে কোরবানীর নিয়মটা একটু অন্যরকম। সবাই যার যার কোরবানী নামাজের পর মাঠে নিয়ে আসে, সেখানেই কোরবানী দিয়ে ভাগের মাংস রেখে বাকিটা বাড়ি আনা হয়। এরপর সবার রেখে আসা মাংস একত্র করে গ্রামের সব পরিবারকে সমান ভাগ করে দেওয়া হয়। এছাড়াও বাড়িতে নিয়ে আসা মাংস থেকেও অনেকে গরীবদের দিয়ে থাকে। ব্যবস্থাটা একদিক থেকে ভালোই। এবারে গরু জবাইয়ের সময় আমি কাছাকাছি ছিলামনা, সময় কাটিয়েছি বাড়িতে, বাচ্চাদের সাথে।
তিন।
দুপুরের আগে বাচ্চারা আবদার ধরলো ওরা শিকারে যাবে, কিভাবে যেন টের পেয়েছে বাড়িতে বন্দুক আছে। সেইমত বন্দুক হাতে দলবেঁধে পেছনের বাগানে। বন্দুকের ভার বইতে না পারলেও একেকজনের টার্গেট প্র্যাক্টিসের বিরাম নেই। সেনাবাহিনীতে থাকা আমার এক ছোট ভাই ওদের ইন্সট্রাক্টর, বাড়ির মেয়েরাও আবার বাদ যাবে কেন? ওরাও এসে জুটলো টার্গেট প্র্যাকটিসে। বাচ্চাদের সাথে মিশে আমরাও কিছুক্ষণের জন্য বয়সটা ভুলে গেলাম। ফিরে গেলাম শৈশবে। বাড়ির পেছন থেকে শুরু করে বন পর্যন্ত বেশ ক’বার দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ফিরে খেতে বসলাম সবাই।
চার।
দুপুরের পর একটু আলসেমী মত লাগলেও উঠে পড়লাম, পরদিনই ঢাকা ফিরবো, হাতে সময় কম, একবার বড়ই বাগানটা দেখে না এলে কেমন হয়। সখের বাগান। পাঁচ একরের বিশাল বাগানের গাছ গুলো দেখতে দেখতে বড় হয়ে গিয়েছে। এবারে ধরেছেও প্রচুর। পাতা আর ফল আলাদা করাই মুশকিল। মাস খানিক পর থেকেই খাবার উপযুক্ত হবে। গতবার ফলনের দাম পাওয়া যায়নি। খেয়াল করে দেখেছি যেকোন সব্জী বা ফল ঢাকায় যে দামে খুচরা বিক্রি হয় খামারে পাইকারী বিক্রি হয় তার তিন ভাগের একভাগ দামে, কোন কোন ক্ষেত্রে তারও কম। আমার পাশের বাগানের কাঁচামরিচ পাইকারী বিক্রি হতে দেখলাম প্রতি ৪০কেজি ৪৭৫টাকা দরে! বাগানে পৌঁছানো মাত্রই বাচ্চারা মেতে উঠলো খেলাতে।
পাঁচ।
সবশেষে আসুন আমাদের বাড়ির নুতন অতিথির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, আশা করি আগামীবছর এই সময় তাকেও অন্যদের সাথে খেলায় মেতে উঠতে দেখা যাবে।
শনিবার, ডিসেম্বর ০৫, ২০০৯
ঈদ ছবির গল্প
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন