শনিবার, ডিসেম্বর ০৫, ২০০৯

ঈদ ছবির গল্প

যাত্রা পর্ব।

প্রথম ধ্বাক্কাটা খেলাম উত্তরার শেষ প্রান্তে মাস্কট প্লাজার মোড়টা পেরুতেই। পেছনে ডান দিকে ঘষা লাগিয়ে দিলো ময়মনসিংহ গামী বাস। মিররে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। এদিকে জ্যাম সবে মাত্র লাগতে শুরু করেছে। বন্ধের সময় সকাল আটে অত গাড়ী ঘোড়া রাস্তায় না থাকারই কথা। ভাবলাম টঙ্গী ব্রীজ পেরুলেই রাস্তা খালি, আরামে চলে যেতে পারবো। আমার ধারণা মিথ্যে প্রমানিত হলো কিছুক্ষণের ভেতরই।চারদিকে শুধু গাড়ী আর গাড়ী, ছোট বড় যাত্রীবাহী গাড়ীর সাথে যুক্ত হয়েছে ট্রাক। সেই ট্রাকেরই আবার নানান কিসিম, কেউ মেঝেতে ত্রিপল বিছিয়েছে কেউবা তোষক। এরই মাঝে চারদিক থেকে ঝুলে ঝুলে মানুষ উঠছে। দূর্বল বিশেষ করে মহিলাদের টেনে টেনে তোলা হচ্ছে ট্রাকের উপর। উপরে উঠতে পারার বা বাড়িতে যেতে পারার সূরাহা হবার আনন্দ তাদের চোখে মুখে। টাংগাইল ছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহের সব জেলায় পৌঁছার প্রধান সড়ক এটাই। সেসব রুটের বাস ছাড়াও বাড়তি কামানোর ধান্ধায় ঢাকা শহরের বিভিন্ন রুটের বাসও চলছে আগাপাশতলা মানুষে বোঝাই হয়ে সে সব গন্তব্যে। কত মানুষ ঢাকা ছাড়ে ঈদে? গাড়ী চলছেনা। মাঝে মাঝে থেমে থাকতে হচ্ছে, এমনও হয়েছে প্রায় ঘন্টা খানিক চুপচাপ বসে আছি, এরপর একটু এগোয়, আবার থামে, আবার এগোয়। গাড়ীতে রেডিয়ো ছেড়ে রেখেছি, চার ঘন্টার এক এপিসোডে থেমে থেমে ক্যান্সারে আক্রান্ত কবি কাজী রোজীর সাক্ষাৎকার শুনলাম। ভদ্র মহিলা পনেরো বছরের উপর ক্যান্সারের সাথে লড়াই চালাচ্ছেন। গাড়ীতে আমি, রিতা আর মাতিস ছাড়াও আছে মাতিসের বন্ধু সাদ্‌। ওরা থাকে নিকেতনে আমাদের উপরের তলায়। সাদের বাবা পাকিস্তানী, বছর আটেক আগে করাচীতে ছুরীর আঘাতে মারা যান, সাদের তখন মাত্র জন্ম হয়েছে। ঘুমানোর আর স্কুলের সময়টুকু ছাড়া প্রায় পুরোটা সময় আমাদের বাসাতেই থাকে। ঢাকার ভেতর কোথাও বেড়াতে গেলে মাতিসের সাথে সাদ থাকবেই, এবারের ঈদে বাড়ী যাবার আগের দিন সাদ কে বলার সাথে সাথে রাজী, ওর মাকেও দেখলাম সানন্দে রাজী হতে, সাথে সাথে ওর ব্যাগ গুছিয়ে দিলেন। সাদের জন্য ঢাকা ছাড়া এই প্রথম, চারদিকে প্রবল উৎসূক্য নিয়ে তাকিয়ে আছে। সবই অসাধারণ লাগছে ওর কাছে। বাস ট্রাকের উপর থেকে গলা বের করে বমি করা দেখতেও তাদের আনন্দ লাগে।ঠিক করেছিলাম তিন সাড়ে তিন ঘন্টা যাই সময় লাগুক বাড়ী পৌঁছেই নাস্তা করবো, গাড়িতে বিস্কিট আছে, ক্ষুধা লাগলে বাচ্চারা খেয়ে নেবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এসে বাড়ীতে ফোন করে জানানো হলো আমরা হয়তো দুপুরের খাবারের সময় এসে পৌঁছাবো। আমার সে ধারণাও সঠিক ছিলোনা, জয়দেবপুরের মোড় যখন পেরিয়েছি বেলা সেসময় দেড়টা, ৩২কিমি রাস্তা পেরুতে সাড়ে পাঁচ ঘন্টার উপর লেগেছে, কল্পনারও বাইরে। এর মাঝে গাড়ীতে ঘষা লেগেছে মোট পাঁচবার। শেষবার ঠিক জয়দেবপুর মোড়টা পেরুবার আগে আগেই। ঠিক করেছিলাম এযাত্রায় মেজাজগরম করবোনা। শেষ বারে তা আর ধরে রাখতে পারিনি।আমার জীবনে যতবার ঢাকা থেকে বাড়ী গিয়েছি তার মাঝে দীর্ঘতম সময় যাত্রার সাড়ে নয় ঘন্টা পর যখন বাড়ীর গেট পেরুলাম সূর্য ততক্ষণে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।ঢাকার তুলনায় ময়মনসিংহে ঠান্ডা বেশী,হঠাৎ করেই কনকনে বাতাস গায়ে লাগা শুরু হলো, আব্বা জ্যাকেট বের করে দিলেন উনার। প্রতিবারের মত আমরা আড্ডায় বসে গেলাম, বাড়ির বউরা রান্না বান্নায়, আগামীকাল ঈদ।

eid adda
এক।

ঢাকায় স্কুল ছুটি থাকলে মাতিস সাধারণত দেরী করেই বিছানা ছাড়ে, ঈদের দিন সকাল সাতটার আগে ওকে বিছানা ছাড়তে দেখে তাই অবাকই হলাম। আমাদের তিন ভাই দেশের বাইরে থাকায় ওরা ছাড়া বাকি পাঁচ জন পরিবার সহ বাড়িতে। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে সংখ্যাটা নিতান্ত কম নয়। সারা বছর খালি পড়ে থাকলেও ঈদের সময় বাড়ি গিজগিজ করে। এদিকে বাড়িতে গিজার লাগানো গোসলখানা একটাই, সাদ আর মাতিসকে গোসল দিয়ে যখন নাস্তা করাতে বসেছি ঘড়িতে আটটা বাজেনি সেসময়। নাস্তার পর ওদের নিয়ে গেলাম বাড়ীর পেছনে। সেখানে প্রথমেই পুকুর, শীত বলে পানি কম, বাঁশ ঝাড় আর সেগুন মেহগিনির বাগান। সে বাগানের পাশে ধানী জমি, তাতে পাকা ধান সোনালী হয়ে আছে। ধান ক্ষেত পেরুলেই বন। ওরা সবাই মেতে উঠলো খেলায়। একবার পুকুরের উঁচু পাড় বেয়ে উঠে আর একবার ধান ক্ষেতের ভেতর দৌড়ে বেড়ায়। সাদকে দেখলাম কিছু ধান ছিড়ে পকেটে ভরতে, ঢাকায় ফিরে মাকে দেখাবে।

Boys are taking breakfast on EID day
Walking through a paddy field
Kids are playing in wooded area
Group of boys on EID day
দুই।

ঠিক দশটায় ঈদ্‌গায়। শীতের দিন, কুয়াশা তখনও কাটেনি। এবারে জামাতে লোক সমাগম কম। কারনটা বুঝলামনা। আমাদের গ্রামে কোরবানীর নিয়মটা একটু অন্যরকম। সবাই যার যার কোরবানী নামাজের পর মাঠে নিয়ে আসে, সেখানেই কোরবানী দিয়ে ভাগের মাংস রেখে বাকিটা বাড়ি আনা হয়। এরপর সবার রেখে আসা মাংস একত্র করে গ্রামের সব পরিবারকে সমান ভাগ করে দেওয়া হয়। এছাড়াও বাড়িতে নিয়ে আসা মাংস থেকেও অনেকে গরীবদের দিয়ে থাকে। ব্যবস্থাটা একদিক থেকে ভালোই। এবারে গরু জবাইয়ের সময় আমি কাছাকাছি ছিলামনা, সময় কাটিয়েছি বাড়িতে, বাচ্চাদের সাথে।

Eid Embrace
Celebrating EID day
Eid Embrace
তিন।

দুপুরের আগে বাচ্চারা আবদার ধরলো ওরা শিকারে যাবে, কিভাবে যেন টের পেয়েছে বাড়িতে বন্দুক আছে। সেইমত বন্দুক হাতে দলবেঁধে পেছনের বাগানে। বন্দুকের ভার বইতে না পারলেও একেকজনের টার্গেট প্র্যাক্‌টিসের বিরাম নেই। সেনাবাহিনীতে থাকা আমার এক ছোট ভাই ওদের ইন্সট্রাক্টর, বাড়ির মেয়েরাও আবার বাদ যাবে কেন? ওরাও এসে জুটলো টার্গেট প্র্যাকটিসে। বাচ্চাদের সাথে মিশে আমরাও কিছুক্ষণের জন্য বয়সটা ভুলে গেলাম। ফিরে গেলাম শৈশবে। বাড়ির পেছন থেকে শুরু করে বন পর্যন্ত বেশ ক’বার দৌড়াদৌড়ি করে ক্লান্ত শরীরে বাড়িতে ফিরে খেতে বসলাম সবাই।

Kids are walking through a paddy field nearby Modhupur forest
Target Practise
Target Practise
চার।

দুপুরের পর একটু আলসেমী মত লাগলেও উঠে পড়লাম, পরদিনই ঢাকা ফিরবো, হাতে সময় কম, একবার বড়ই বাগানটা দেখে না এলে কেমন হয়। সখের বাগান। পাঁচ একরের বিশাল বাগানের গাছ গুলো দেখতে দেখতে বড় হয়ে গিয়েছে। এবারে ধরেছেও প্রচুর। পাতা আর ফল আলাদা করাই মুশকিল। মাস খানিক পর থেকেই খাবার উপযুক্ত হবে। গতবার ফলনের দাম পাওয়া যায়নি। খেয়াল করে দেখেছি যেকোন সব্জী বা ফল ঢাকায় যে দামে খুচরা বিক্রি হয় খামারে পাইকারী বিক্রি হয় তার তিন ভাগের একভাগ দামে, কোন কোন ক্ষেত্রে তারও কম। আমার পাশের বাগানের কাঁচামরিচ পাইকারী বিক্রি হতে দেখলাম প্রতি ৪০কেজি ৪৭৫টাকা দরে! বাগানে পৌঁছানো মাত্রই বাচ্চারা মেতে উঠলো খেলাতে।

Kids seating on a wooden watchtower inside a Lemon garden at Madhupur forest enjoying scenic beauty.
Kids are taking rest after a walk
Picking lemon from garden
পাঁচ।

সবশেষে আসুন আমাদের বাড়ির নুতন অতিথির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, আশা করি আগামীবছর এই সময় তাকেও অন্যদের সাথে খেলায় মেতে উঠতে দেখা যাবে।


New to our family

তাৎক্ষণিক নভেম্বর ২৫, ২০০৯

১।

গতকাল হঠাৎ করে মাস্টার্সের সার্টিফিকেটের প্রয়োজন পড়লো। সার্টিফিকেটানুযায়ী আমার মাস্টার্স পাশের বছর ১৯৮৪, যদিও সামরিক শাসনের জন্য অনির্ধারিত বন্ধে আমরা চুড়ান্ত পরীক্ষা দিয়েছিলাম ‘৮৭তে। ২৫ বছর যাবৎ এই সার্টিফিকেট ছাড়াই জীবন পেরিয়ে এলেও এখন এটা খুঁজতে যেয়ে জান বেরোবার উপক্রম। মনে আছে ৮৯’র দিকে ইউনিভার্সিটি থেকে সার্টিফিকেট তুলেছিলাম এবং সে বছরই কোন এক এরশাদ ভ্যাকেশনে মহসিন হলে পুলিশি তান্ডবে রুমে রাখা আমার সার্টিফিকেট গুলো অন্যান্য জিনিষপত্রের সাথে হারিয়ে গিয়েছিলো পেয়েছিলাম শুধু একটা ফটোকপি। এতদিন পর প্রায় পাঁচ ঘন্টা তন্নতন্ন করে খুঁজে অনেক কাগজের মাঝে অবশেষে সেই ফটোকপি হাতে পেয়েছি। আজ আবার ইউনিভার্সিটি দৌড়াতে হবে এটার মূল কপি তুলতে।

২।

আমাদের বাসায় জিনিষপত্র এমনিতেই কম। তারপরেও খুঁজে পেতে দেরী হবার কারন ভিন্ন। মাঝে মাঝে বিশেষ কিছু জিনিষ যেমন কার্ড, বই, ছবি, ক্যাটালগ ইত্যাদি কিছুদিন পর দেখবো বলে জমিয়ে রাখতাম এবং যথারীতি ভুলেও যেতাম। গতকাল তেমন একটা বই হাতে পেয়ে অনেক্ষণ ধরে দেখলাম। ২০০২ সালের দিকে একটা ব্যাংকের অর্থানুকুল্যে ডঃ নওয়াজেশ আহ্‌মেদের তোলা ছবি আর রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রের লাইন নিয়ে ছবির বই বেরোয়েছিলো। মনে পড়ে সীমিত ছাপা (১০০০কপি) এই বইটি সেই ব্যাংকের সেরা গ্রাহকদের মাঝে বিনামূল্যে দেয়া হয়েছিলো। ২০০৫ এর দিকে একবার আমার ছোট ভায়ের অফিসে যেয়ে বইটি দেখে নিয়ে এসেছিলাম এবং যথারীতি ভুলেও গিয়েছিলাম। গতরাত প্রায় দুইটা পর্যন্ত বইয়ের ছবিগুলো দেখলাম। প্রায় ছবিই পদ্মার আশেপাশে তোলা। কিছুদিন আগে ডঃ আহ্‌মেদের সাথে আড্ডায় উনি আবারো পদ্মায় সময় কাটানোর কথা বলেছিলেন, জানিয়েছিলেন উনি ডিজিটাল ক্যামেরা কিনবেন যদি আমরা উনার সাথে পদ্মায় যাই। বলেছিলাম এটা আমাদের মত যে কারো জন্যে ভাগ্যের ব্যাপার হবে যদি উনার সাথে ছবি তোলা নিয়ে কিছুদিন কাটাতে পারি। বইটা দেখতে দেখতে ঠিক করলাম আজকেই উনার সাথে যোগাযোগ করবো এব্যাপারে। আমার দূর্ভাগ্য আমি জানতামনা যখন উনার তোলা ছবিগুলো দেখছি সেসময় উনি সব ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছেন।

20090207_2503
৩।

আমাদের বাসা থেকে আমার অফিস প্রায় নয় কিমি। এটুকু রাস্তার প্রথম দেড় কিমি পেরুতে আধ ঘন্টার উপর সময় লাগে, আজ লেগেছে পাক্কা ৪৫মিনিট। প্রতিবছর কোরবানীর ঈদে বাড়ি যাই, সাধারণত ঈদের আগের দিন, এবারেও হয়তো তার ব্যতীক্রম হবেনা, সব ঠিক থাকলে আগামী শুক্রবার ঢাকা ছাড়বো। ফিরে আসবো ঈদের পরদিন। ইদানীং ঢাকা ছাড়া খুব ঝামেলার। ১৬০কিমি দূরে বাড়ীতে যেতে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার অর্ধেক সময় লাগে ঢাকা ছাড়তে। ঈদের আগে এখনই ঢাকার যে অবস্থা তাতে পাঁচ ঘন্টায় যেতে পারলেও স্বস্তি।

Busy City
৪।

প্রতিবছরের মত এবারেও আমাদের অফিসের ক্যালেন্ডার ছাপাতে দিয়েছি, আগামী মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বিতরন শুরু করবো, গতবছর এসময় উত্তরায় এক মেগা সচলাড্ডায় বেশ কিছু ক্যালেন্ডার পাঠিয়েছিলাম বিতরনের জন্য, সেদিন সিলেট থেকে ফিরছিলাম, মনে আছে বিডিআর আর নজরুল ভাই বার বার ফোনে খোঁজ নিচ্ছিলেন কতদূর এসেছি, শেষ পর্যন্ত যদিও যাওয়া হয়নি সেখানে। আজ হঠাৎ মনে হলো এবারেও কী তেমন এক বিশাল সচলাড্ডার আয়োজন করা যায়না?

Calendar
৫।

এবারে একটু অন্যরকম খবর। গেটি ইমেজের নাম অনেকেই শুনেছেন। অনেকদিন যাবৎই ওরা আমার ছবি চাচ্ছিলো বিক্রি করার জন্য। গেটিতে ছবি দেয়ার নানা ঝামেলা, কপিরাইটের কারনে ওরা এমন এমন কাগজপত্র চায় তাতে মনে হয় সেখানে ছবি দেয়া হয়তো কোনদিন হবেনা। এরমাঝে একটামাত্র পাঠিয়েছিলাম, সেদিন দেখি ওরা চেক পাঠিয়ে দিয়েছে ডাকে। সেই চেক আমাদের দেশের অনেক নিয়ম কানুনের বেড়াজালে পড়ে এখনও জমা দেয়া হয়নি। আদৌ হবে কীনা সেটাও বলতে পারিনা। ছবিটা দেখুন, তিওমানে বেড়াতে যেয়ে G9 ক্যামেরায় তোলা।


Salang beach, Tioman Island