ভোর চারটা। আমি ঘুমানোর চেষ্টা করছি। মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে। মনে হচ্ছে এখনও দৌড়ের উপর, গাড়ি চালাচ্ছি, একবার ডানে আরেকবার বামে ঘুরছি আমি। বালিশে মাথা রেখে মনে হলো বিছানা দুলছে। উঠে যেয়ে এসি ছেড়ে দিলাম, একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেলো ঘরটা জুড়ে। উলটো দিক থেকে গুনতে শুরু করলাম এবার একশো, নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই...
বেলা এগারোটা। চর আলেকজান্ডার। একটু আগে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার টেবিলে, সবার নাস্তা সারা হয়ে গেছে এরই মাঝে। মাতিস দৌড়াচ্ছে এ ঘর থেকে সে ঘরে, আবার দৌঁড়ে বাইরে গেলো, আমার নাস্তা প্রায় শেষ এমন সময় কাছে এসে বললো “বাবা শব্দটা কীসের?” আমি বললাম ঝিঁ ঝিঁ পোকা।
মফস্বল শহরের পাকা বাড়ি, যখন বানানো হয় নদী ছিল পনেরো কিলোমিটার দূরে। এখন এক কিলোমিটারও হবে না, তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একতলা বাড়ি উপরে বাড়েনি। বিশাল এলাকা নিয়ে বাংলো মতন বাড়িটার সামনে পেছনে দুটো পুকুর, বৃষ্টি নাই বলে নিচের মাটি দেখা যায়। আর আছে গাছ, আম, জাম্বুরা, কাঠ বাদাম, কামরাঙ্গা, সুপারি, নারকেল কত জাতেরই না গাছ দেখলাম সেখানে। শাঁসওয়ালা ডাবের পানি হাতে মাতিসের সাথে বাইরে এলাম, সামনে পেছনে, উপরে নিচে একটানা ডেকে গেলেও একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকারও সন্ধান করতে পারলাম না।
‘৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের এ এলাকার উপর দিয়ে তাণ্ডব বয়ে গিয়েছিল। আমি তখন ছোট। থাকতাম ময়মনসিংহে। মনে আছে সকাল থেকেই চারদিক ছিল সন্ধ্যা সন্ধ্যা, ঘন নীল আকাশ আস্তে আস্তে নেমে আসছিল নিচের দিকে, সেই নীলাকাশ কালো হবার আগেই স্কুল ছুটি হয়ে গেলে বাসায় ফিরতে ফিরতে চারদিক অন্ধকার। পরবর্তী কয়েকদিন বড়োভাই পত্রিকা কেটে কেটে ঝড়ের ছবি জমিয়েছে, ইত্তেফাক, আজাদ এসব পত্রিকার পাতায় পাতায় বীভৎস সেসব ছবি, পাতাহীন বিশাল বৃক্ষের চূড়ায় পতাকার মতো আটকে আছে টিনের চাল কিংবা দুলছে মানুষের লাশ। চর আলেকজান্ডারের নাম তখনই শোনা। ইচ্ছা ছিল গৃহকর্তার থেকে সেদিনের বিবরণ শুনব, বয়সের ভারে চোখ আর কান দুটোতেই উনার সমস্যা থাকায় সে সুযোগ হলো না। বাড়ির বড়ো ছেলে মুক্তিযোদ্ধা হান্নান ভাই সুইডেন প্রবাসী, জুনে ফেরার কথা, ইচ্ছাটা তখনকার জন্য তুলে রেখে বর্তমানে ফিরে এলাম।
কানাডা প্রবাসী মাতিসের বড়োমামীদের পৈত্রিক নিবাস এখানে। মার্চের ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার অফিস করে কাপড় না বদলেই রওয়ানা দিয়েছিলাম। তখন বিকেল ছয়টা, ধারণা পেয়েছিলাম রাত বারোটার আগেই পৌঁছে যেতে পারি আলেকজান্ডার। কিন্তু রাত আটটা বেজে গেলেও যখন কাচপুর সেতু পেরুতে পারলাম না বুঝলাম দুঃখ আছে কপালে। কাচপুর পেরিয়ে কুমিল্লা, সেখান থেকে লাকসাম, সোনাইমুড়ি, বেগমগঞ্জ হয়ে লক্ষ্মীপুর পর্যন্ত চলে এলাম মোটামুটি শান্তভাবেই। সামনের সিট এলিয়ে মাতিস নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। পেছনে রিতা আর মাতিসের নানা। টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে আমাদের মাঝে, সমস্তই আমি যেন গাড়ি চালাতে যেয়ে ঘুমিয়ে না পড়ি সেজন্য। লক্ষ্মীপুর এসে শুনলাম আরো চুয়াল্লিশ কিলোমিটার যেতে হবে। এই সেই চুয়াল্লিশ কিলোমিটার, মনে হলো এবড়ো খেবড়ো উঁচু নিচু মাটির রাস্তায় খুব জোরে চালানো গরুর গাড়িতে বসে আছি। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে ঝাঁকি খেতে খেতে রাত তিনটা নাগাদ সে রাস্তাও পেরিয়ে সবাই যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে আমি তখন ভাবছি কয়েকঘন্টা পরই আবার এ রাস্তাতেই আমাকে ফিরে যেতে হবে।
শুক্রবারের দুপুর, চারদিক প্রচণ্ড গরমের মাঝে বের হলাম মেঘনার মোহনা দেখব বলে। বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে যেখানে সরকারি রাস্তা এসে মেঘনায় ক্রমাগত বিলীন হয়ে যাচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম এর বিশালত্ব। আমার সামনে তিনদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পানি আর পানি, সামনের নীল পানি দৃষ্টি সীমার ওপারে ধূসর হতে হতে মিশে গেছে আকাশের সাথে। কড়া রোদে আকাশে মেঘ নেই, বর্ণ নেই। নদী আর আকাশের সীমানা তাই আলাদা করা যায় না। পায়ের নিচে ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে মাটি সরিয়ে নিয়ে যায়। সে মাটির রং কালো, মাটি উর্বর। এখানে পানির গভীরতা সর্বোচ্চ দুই হাজার ফুটের কাছাকাছি।
আমরা সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। কত দেশ কত জনপদ পাড়ি দিয়ে, কতজনের দুঃখ আর ভালোবাসা বুকে নিয়ে মেঘনা এসে মিশে যাচ্ছে সাগরে। গঙ্গা, যমুনা আর ব্রহ্মপুত্রের প্রায় সব পানি যে ধারণ করতে পারে তার বিশালত্ব কীভাবে কল্পনা করি আমি? বিশ্বের সবচাইতে চওড়া নদীগুলোর একটি এই মেঘনা এখানে প্রায় ১৫কিলোমিটারের মতন চওড়া ভাবতেও কেমন যেন লাগে।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে তার পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান, দুটো বেঞ্চ আর একটা টুল। মাতিস সেই কখন থেকে টুলে বসে আছে, রোদে পুড়ে যাচ্ছে কিন্তু উঠার নাম নেই, তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, সেদিকে একটার পর একটা ঢেউ লাখ লাখ গ্যালন পানি নিয়ে ফেলছে সমুদ্রে, ঢেউ এর মাথায় মাঝে মাঝেই ভেসে উঠছে শুশুক। সে বসে আছে, আমিও যেয়ে বসলাম ওর পাশে। আস্তে করে মাতিস আমাকে বললো “বাবা, আমরা আর কোনোদিন কি এখানে আসব?’
আমাদের ফিরতে হয়, ফিরতে হয় কিছু মন্ত্রমুগ্ধ সুন্দর সময়ের স্মৃতি নিয়ে, যেই স্মৃতি একসময় গল্প হয়ে ভেসে বেড়াবে প্রজন্মান্তরে। তবে ফেরাটা অসহনীয় ছিল না মোটেই। মেঘনার মোহনা দর্শন সাথে আলেকজান্ডারের মহিষের দুধের দই আর ইলিশের স্বাদ ফেরার পুরোটা পথ যেভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাতে ঢাকায় ফিরেও মনে হচ্ছিল আবারো যাওয়া যেতে পারে সেখানে।