মুস্তাফিজ কথন
শুক্রবার, মার্চ ০৯, ২০১২
সোমবার, জানুয়ারী ১০, ২০১১
ভয়াল সুন্দর সুন্দরবন
এই ভোরে কী যে ঠাণ্ডা লাগে, হাড় পর্যন্ত জুড়িয়ে যায়। একটু পরই হাঁটুসমান কাদাপানিতে নামতে হবে ভেবেই কি তোমার উপর শীত আরো জেঁকে বসছে? ট্যুর কোম্পানির পাতলা চাদরটা অনেক আপন ভেবে আরেকটু জড়িয়ে নিলেও তরুণ ফটোগ্রাফারদের জ্বালায় একটু দেরি করে উঠবে সে উপায় তো নেই, দরজায় টোকা “বস্, ছয়টা বেজে গেছে”, গলাটা আখলাসের, ওকে চেনো? হাওড় অঞ্চলের মানুষ এখন সিলেটে স্থায়ী, ওর ঝুলিতে ছবি সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সংখ্যার হিসাব সে নিজেও জানে না। আস্তেধীরে উঠে আসো, গলায় মাফলার জড়িয়ে দরজার সামনের দুই ফুট খোলা প্যাসেজে দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নাও, মন জুড়িয়ে যাবে। এখানে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাও, বুঝতে পারবে ভাটায় পানি প্রায় পাঁচ ফুট নেমে গেছে, পাশে আমাদের লঞ্চের সাথে বাঁধা ইঞ্জিনবোটের ভেজা ছাদে দেখো ইতোমধ্যেই বসে গেছে কয়েকজন, মাহবুব আর মফিজ ভাইকে দেখো সাবধানে বোটে পা রাখছে, আবার না পিছলে যায়!
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে মাথা ঝিমঝিম করছে? কিছু না, গতরাতে দেড়টা পর্যন্ত খোলা ছাদে বসে আড্ডা মারার ফল। আচ্ছা, আড্ডার বিষয় মনে আসছে না কেন? শেষ কবে এমন আড্ডা হয়েছিলো তা কি মনে করতে পারবে? আমি জানি পারবে না। ঢাকার জীবনে আড্ডার কথা মনে থাকে না, তবে আমি বলে দিলাম নাগরিক কোলাহলের বাইরে সুন্দরবনে কাটানো এই কয়টা দিনের কথা আজীবন মনে থাকবে তোমার। বোটে ওঠার মুখেই ফ্লাক্সে গরম চা দেখে এক কাপ হাতে নেবার ইচ্ছা থাকলেও সাবধান, একটু আগেই লীলেনদাকে বলতে শুনেছি “শালারা চায়ে চিনির বদলে লবণ দিয়েছে”।
তোমার আর চা খাওয়া হবে না। এই যে তোমার হাতে বিস্কিট ধরিয়ে গেল ওর নাম রাশেদ, কুটকুট করে দুটো বিস্কিট শেষ হতে না হতেই দেখো নৌকা ভরে উঠছে, ভেজা ছাদে এক এক করে আসন পেরে বসছে তুষার, শাওন, অরূপ, জিলাল, আলমগীর, সাদিক সবাই। আমার জন্য প্লাস্টিকের চেয়ার আসাতে হাসি পাচ্ছে তোমার, তাতে কী? দেখো সে চেয়ার নিয়ে অবলীলায় আমি বসে যাচ্ছি নৌকার একদম সামনের দিকে।
লঞ্চের আড়াল থেকে নৌকা সামনে চলে এসেছে। সামনের দিকে তাকাও, কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে নদীর উপর, শীতের ভোরে গ্রামে খোলা চুলায় রান্না বসালে যেমন ধোঁয়া আসে ঠিক তেমনি ধোঁয়া উঠছে পানি থেকে, ভাটার নদী এখানে এখন ৫০ হাত চওড়া হবে কিংবা একটু বেশি, দৃষ্টি এখানে বেশিদূর পাবে না, কিন্তু চোখ মেলে দেখো রঙ আর ছায়ার কী অপরূপ খেলা, নদীর পানি, দুপাশের কালচে কাদা তারপর সবুজ হলুদ বন, সবই কেমন নীলাভ মায়াবী আলোয় মিশে আছে, একশ হাত দূরে সবই দেখো নীল হয়ে আছে আর তারপর থেকে কী অদ্ভুতভাবে সবই হয় সাদা না হয় কালো।
খুব ছবি তুলতে ইচ্ছা করছে তাইনা? তাহলে ডান দিকে তাকিয়ে বসো, নৌকা এখন ডান পাড় ঘেঁষে যাচ্ছে। চিকন রুপালি নদী, নৌকা থেকে দশ হাত দূরে মাটি দেখা যায়, এই কাদা, মাটি আর পানির মিলনরেখায় বক খাবার খুঁজছে, ছবি তুলবে? থাক বরঞ্চ আরেকটু উজানে তাকাও, বিশাল পাখিটা দেখতে পারছো না? তুমি বরং এদের লম্বা সাদা লেন্স বরাবর তাকাও, হ্যাঁ হ্যাঁ এটা, এটার নাম মদনটাক, আস্তেধীরেই তোলো, ক্ষুধার্ত পাখি সহজেই উড়ে যাবে না। এই ফাঁকে তোমাকে একটা কথা জানিয়ে রাখি, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র দেখার সবচাইতে ভালো সময় ভোরবেলা যখন ভাটা থাকে। সবাই তখন খাল নদীর কাছাকাছি চলে আসে খাবারের খোঁজে, পানি বাড়তে থাকলে, বেলা বাড়তে থাকলে আস্তে আস্তে ভেতরে চলে যায়। আরে ঐদিকে দেখো সব ক্যামেরা একসাথে ক্লিক ক্লিক করে উঠছে, দেখতে পাচ্ছো? হুঁ হুঁ আমিও পারছি, একটা, দুইটা, তিনটা, আরে আরে একটু ভেতরে তাকিয়ে দেখো অগুনতি হরিণ, সাথে বানর, কেওড়া ফলে নাস্তা সারছে। খেয়াল করে দেখো ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখলেও সরে যাচ্ছে না ভয়ে।
আমরা পশ্চিমে এগুচ্ছি, একটু পরই সামনে যে বাঁকটা দেখা যাচ্ছে সেখান থেকে ডান দিক দিয়ে ইউটার্ন নিয়ে আবার পুবে চলে আসবো। দেখো দেখো বাঁকটা তো অসম্ভব সুন্দর, পেছন থেকে সূর্যের আলো পরে বাম দিকের গাছ গুলো ঝিকিমিকি করছে, তাই না? কী বললে? গাছের নাম? ও হ্যাঁ, এগুলো “কেওড়া”, নিচের ছোটোগুলো “গরান”, সামনের ঝিলিক দেয়া গাছটা সম্ভবত “জানা”, আর এই যে বিশাল সাইজের ঝুমকার মত ফল ঝুলে আছে এটা গোলপাতা। আর ঐটা, হুম, শোন, আমরা এখন নিষিদ্ধ এলাকায়, বাঘের অভয়ারণ্য এটা, সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ এখানে, তারই সাবধাবাণী দিয়ে সাইনবোর্ড। তার সামনে দেখো গরান গাছের ফাঁকে পতাকা ঝুলে আছে একটা, হ্যাঁ, ছেঁড়া লুঙ্গি দিয়ে বানানো পতাকা, বাঘ যেখান থেকে কোনো মানুষ ধরে নিয়ে যায় তারই আশেপাশে উঁচু ডালে সেই হতভাগ্যের সঙ্গীসাথীরা একটা কিছু ঝুলিয়ে রাখে অন্যদের সাবধান করার জন্য। বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার, তাই না? একটু সামনে বায়ে তাকাও, গরান গাছের গোড়া থেকে পানি পর্যন্ত কাদায় ফুটখানেক চওড়া দাগটা খেয়াল করো, এই ভাটাতেই একটা বাঘ এখান দিয়ে খাল পেরিয়ে ওপারে গিয়েছে, এবারে ডানে তাকাও, ঠিক এই দাগটা বরাবর উল্টোদিকে দেখো বাঘ লাফিয়ে পানি থেকে ডাঙায় ওঠার চিহ্ন রেখে গেছে। আর এই ঝনাৎ শব্দ? আমাদের গার্ড মজিদ আর সুমন তাদের রাইফেল ঝাঁকিয়ে নিলো নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশের সতর্কতা হিসাবে।
ভয় ভয় লাগছে তোমার বুঝতে পারছি, কিন্তু পাড় ঘেঁষে ঐ ছোটো নৌকার দিকে তাকাও, দুজন মানুষ কাদায় একের পর এক বাক্স বসিয়ে যাচ্ছে, এগুলো কাঁকড়া ধরার ফাঁদ, এক ভাটায় বসিয়ে আরেক ভাটায় তুলে নিবে। জোয়ারে ভেসে আসা কাঁকড়া খাবারের লোভে আটকা পড়বে খাঁচায়, ওরা ধরে ধরে জমাবে নৌকার খোলের ভেতর, ৩/৪ দিন পর পর মহাজনের ইঞ্জিন নৌকা এসে কাঁকড়া নিয়ে যাবে বিনিময়ে মিলবে এদের খাবার। ওরা থেকে যাবে সুন্দরবনে। আত্মরক্ষার জন্য ওদের সম্বল কেবল ইঞ্চি ন’য়েক লম্বা দা। আশ্চর্য হচ্ছো তাইনা, নৌকা কাছে আসুক বুঝতে পারবে কতটুকু গরিব হলে মানুষ এরকম বিপদসংকুল পেশা বেছে নেয়? দুই তিন প্রস্থ গরম কাপড় জড়িয়েও যেখানে ঠাণ্ডা লাগছে তোমার সেখানে দেখো একজন রীতিমত হাঁপাচ্ছে, হাঁপানি আছে নিশ্চয়ই, এই ঠাণ্ডাতে আরো বেড়েছে মনে হয়। পাশের খাকি প্যান্ট পরা লোকটার কথা বলছো? না, সে ফরেস্টের কোন গার্ড না, হয়ত তাদের ফেলে দেয়া পোশাক পরনে, খেয়াল করো সেই প্যান্টের চেইন নেই, বোতাম নেই, একটা চিকন দড়ি দিয়ে কোমরের সাথে বাঁধা, আমাদের দেখে ছেড়া গেঞ্জি টেনে নিচে ঢেকে দেবার কী আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে!
তুমি জানতে চাইলে আমরা কোথায় যাচ্ছি। আসলে কোথাও যাচ্ছি না আমরা। রাতে আমাদের লঞ্চ যেখানে নোঙর করেছিলো তার ডান দিকের যে বন তার চারদিকেই নদী কিংবা খাল। একটা বৃত্তের মত নৌকায় সে নদী খাল ঘুরে আমাদের নোঙর করা জায়গাটার উল্টোদিকে কাদায় নামবো আমরা, সেখান থেকে সোজা বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আবার এপারে চলে আসবো। এ নিষিদ্ধ এলাকায় এভাবে ঘোরার রোমাঞ্চ নিশ্চয় টের পাচ্ছো এখন, তুমি আরো রোমাঞ্চিত হবে শুনলে যে আমাদের গাইড কিংবা গার্ড কিংবা ফটোগ্রাফারদের কেউই এ রাস্তা চেনে না, শুধু আমি ছাড়া। এই ভোরে আধো আলো আঁধারিতে একবার পথ হারালে বিপদ, সারাদিন ঘুরতে হবে খালে খালে। ঐ যে সামনে শুকনো খাড়িমতন দেখা যাচ্ছে, নৌকা আমাদের সেখানে নামিয়ে ফিরে যাবে। ঐদিক দিয়েই ভেতরে ঢুকবো আমরা।
সাবধানে নেমে এসো। কাদা যদি হাঁটুর উপরে উঠে যায় খবরদার সামনে এগুনোর চেষ্টা করবে না, যতই চেষ্টা করবে দেখবে আস্তে আস্তে দেবে যাচ্ছে পা। হাঁটু দেবে গেলে কাদায় জোর চলে না। আর খেয়াল করে পা ফেলবে, এখানকার কাদা পিচ্ছিল, একবার পিছলে গেলে বিপদ, নির্ঘাত নিচ থেকে বর্শার মতন উঠে আসা শুলে ক্ষতবিক্ষত হতে হবে। দৃষ্টি রাখবে নিচুতে, প্রতি ইঞ্চিতে এখানে বিপদ, সাধারণ নিরীহ শুকনো পাতার নিচেই পড়ে আছে বিষাক্ত কাঁটা। ঠিক আছে এই লাঠিটা হাতে রাখতে পারো, তাতে ভর দিয়ে হাঁটতে সুবিধা হবে তোমার। কাদা পেরিয়ে সবার নেমে আসার অপেক্ষায় একটু দাঁড়াও, একসাথে ঢুকবো আমরা, এক লাইনে, কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবে সবার।
নিশ্চয়ই তোমার এবারকার প্রশ্ন হবে কেনো এলাম আমরা এখানে। এর উত্তর পাবে একটু পরই, সামনের ছোটো ছোটো গাছগুলো সরে যেতে দাও, এবারে একটু এপাশে এসো, তাকাও সামনের দিকে, চোখ মেলে দেখো কী অপার্থিব সৌন্দর্য চারদিকে, এ সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, পৃথিবীতে এমন সৌন্দর্যমণ্ডিত জায়গা কেউ দেখেছে বলেও জানি না। চুপ করে বসে থাকো, মন খুলে গান গাও কিংবা আলতো পা ফেলে ঘুরে বেড়াও। এ স্মৃতি রয়ে যাবে আজীবন, একদিন বয়স হলে পরবর্তী বংশধরদের কাছে আসর জমিয়ে গল্প করতে পারবে এ ভয়াল সৌন্দর্যের। যাই করো শুধু একটি কথাই ভুলে যেয়ো না তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছো ঠিক তার পাশেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার হেঁটে যাবার টাটকা ছাপ দেখা যায়।
তুমি কি বুঝতে পারছো গতকাল এখানে এসেছিলাম আমরা, জায়গাটা চেনা চেনা লাগছে কি? হুম, আমি জানতাম তুমি বলবে একবার মনে হয় এসেছিলাম আবার মনে হয় না তো ঠিক এরকমই হবে সেই জায়গাটা। আসলে এরকমই হয়, প্রতি মুহূর্তে এখানে রূপ পাল্টায় সুন্দরবন। প্রকৃতির এই বিশাল সম্ভার কখনোই একেবারে পুরোপুরি মেলে দেয় না নিজেকে। তাছাড়া বনের পারিপার্শ্বিকতাও আমাদের দেখার চোখ আর মনকে প্রভাবিত করে। তাই চেনা জায়গাকেও আবার নতুন করে চিনতে হয়।
গতকাল যখন এসেছিলে তখন ছিলো ভোর, সূর্য তখনও সমুদ্র থেকে উঠে আসেনি। পাতলা একটা কুয়াশার চাদর ঢেকে রেখেছে চারদিক, তুমি কি খেয়াল করেছিলে সেই কুয়াশার রঙ নীল? ভাঙা কাঠের পুল বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম কুয়াশার রঙ এখানে নীল কেন হবে, পরে বুঝলাম শিশিরে ভেজা সবুজ হলুদ গাছের পাতা থেকে ঠিকরে বের হওয়া আভাতেই উপর দিকে নীল দেখাচ্ছে, সূর্যের আলো বাড়তে থাকলে কুয়াশাগুলো যখন উপর দিকে উঠতে থাকবে নীল রঙ আর থাকবে না। এই যেমন আজকে, দেখো। কী মজার, তাই না?
ইসসস... সা-ব-ধা-ন... , দৌড়াবে না, আমি হাতের কাঠিটা ডানে নাড়ালে তুমি বাম দিক দিয়ে বেড়িয়ে যাবে, আরেকটু সামনে যাও, আস্তে, এখন দাঁড়াও আমি আসছি। বাহ্, ভালো একটা জিনিস দেখতে পেলে, এটা ছিলো শঙ্খচূড়, ইংরেজি কিং কোবরা, তবে প্রচলিত কোবরা বা গোখরার মতন এদের মাথার পেছন দিকে চক্রটা থাকে না। কী বললে? হ্যাঁ, প্রথম দেখাতেই আমি খেয়াল করেছি সেটা। গোখরার চাইতে এরা বেশি বিষাক্ত, এর ছোট্ট একটা কামড় আমাদের স্নায়ু নির্জীব করে দিতে পারে দশ মিনিটেই। অন্য সাপ খেয়ে বেঁচে থাকা শঙ্খচূড় সুন্দরবনের বিষাক্ত প্রাণীগুলোর মাঝে প্রধান। আহ্ কী যে বলো! এটা ছোট সাপ? দাঁড়াও একটা ছবি তুলেছি, দেখাবো তোমাকে, কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ছিলো বলে বুঝতে পারোনি, শঙ্খচূড় প্রায় ১৮/১৯ ফুট লম্বা হয়, আর এটা ছিলো ১৫ ফুটের বেশি!
এই একটা ঘটনাতেই চারদিক কেমন অন্যরকম হয়ে গেলো খেয়াল করেছো? নিজের কথাই ভাবো, তুমি কি আরেকটু বেশি সতর্ক হয়ে যাওনি? সামনের এই ছোট্ট ঝোপটা পেরুতে এখন আগের চাইতে দুইগুণ সময় বেশি নিবে তুমি আমি জানি। আচ্ছা ঠিক আছে, ঝোপের মাঝ দিয়ে যাবার দরকার নেই, ডানে ঘুরে চলে এসো। নিচের দিকে তাকাও, এগুলো হরিণের দাগ, হ্যাঁ, যখন জোয়ার থাকে পানি এখানেও উঠে আসে, জোয়ার নেমে গেলে কাদা মাটিতে হরিণ হেঁটে গেলে পায়ের ছাপ রেখে যায়, এই যে চষা জমিনের মতন অগুনতি পায়ের ছাপ এগুলো একদিনে হয়নি, মানুষের পদচিহ্ন এদিকে পড়ে না বলেই ক্রমাগত খুরের ছাপ পড়তে পড়তে এখন চষা জমিনের মতন দেখাচ্ছে। এই যে লম্বা গাছগুলো দেখছো, এগুলো কেওড়া, এখান থেকে কিছু পাতা ছিড়ে নিচে ফেলে গাছে উঠে চুপচাপ ঘণ্টাদুয়েক বসে থাকো, দেখতে পাবে একদম কাছে থেকে বন্য হরিণ, চিড়িয়াখানার হরিণের চাইতে এদের গায়ের রঙ উজ্জ্বল আর আরো বেশি সতর্ক, তোমার একটু নড়াচড়াতে কোথায় যে পালাবে সারাদিন আর খুঁজেই পাবে না। তারপরও এরা বাঘের খপ্পরে পড়ে। বাঘ তো বাঘ আমাদের আবদুল ওয়াহাবের কথা বলেছিলাম তোমাকে? বাপ্পিদার সহকারী এ ছেলেটা এত সতর্ক হরিণকেও হাত দিয়ে ধরে নিয়ে আসে! এই ওয়াহাবের সেদিন কী হয়েছে শোনো।
সেদিন এক মাছ ধরা দলের ট্রলারে করে ভেতরে যাচ্ছিলো ওরা, ট্রলারে বাঁধা প্রায় ২০টার মতন নৌকা, খালে খালে একেকটা নামিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে গেছে, ছোট্ট একটা খালে ট্রলার তখন, এমন সময় হঠাৎ গুলির শব্দ, ওয়াহাব তাকিয়ে দেখে বোটম্যান পরে যাচ্ছে কাত হয়ে, সাতপাঁচ না ভেবে পেছনে ডিগবাজি খেয়ে টুপ করে পানিতে নেমে যায় ওয়াহাব, সে সাঁতরে ওপারে উঠার আগেই মাঝি ছাড়া ট্রলার যেয়ে ঠেকে ডাকাতদের বোটে, ওপারে গাছের আড়াল থেকে বিস্মিত ওয়াহাব দেখে কী নির্দয় পিটুনি দিচ্ছে ডাকাতরা তার সহযাত্রীদের, শেষ পর্যন্ত ট্রলার ফুটো করে দিয়ে একজনকে নিহত আর একজনকে জিম্মি হিসাবে আটক করে চাঁদার দাবি জানিয়ে ফিরে যায় ডাকাতরা। বনজীবীরা হিংস্র পশুর চাইতে বেশি ভয় করে সুন্দরবনের এই ডাকাতদের। সুন্দরবনের কোথায় ডাকাত নেই? গামা, জুলফিকার, রাজু এরকম বিভিন্ন বাহিনীর নাম তো গতকালই শুনলে। বাঘকে এরা মামা বলে আর ডাকাত দলের নাম বলে ছোট ভাই, বড় ভাই। গতকালের কথাই ভাবো, এত কষ্ট করে দুবলার চরে যেয়ে ডাকাতদের হুমকিতে ফিরে আসতে হলো আমাদের। আমরা নাহয় বেড়াতে যেয়ে ফিরে এলাম, কিন্তু যারা সেখানে থাকে ওদের কথা একবার ভেবেছো তুমি? অসম্ভব সাহসী যেই মানুষগুলো অসীম সাগরের গভীর থেকে মাছ তুলে এনে আমাদের খাবার যোগায় এই এরাই ডাঙাতে কত নিরুপায় জীবন কাটায়? গতকাল আমরা যদি সেখানে না থাকতাম বাইরের দুনিয়া জানতেই পারত না কী ভয়ংকর লুটপাট আর তাণ্ডব চালিয়ে আটজনকে ধরে নিয়ে গেছে সেখান থেকে।
সাবধানে পা ফেলো, নিচে যে শূলগুলো দেখছো এগুলো গাছের শিকড়, নোনা পানিতে মাটি ঢেকে যায় বলে বাতাসের জন্য শিকড়গুলো এভাবে উপরে উঠে আসে, মাথায় ধার আছে, তোমার জুতোর নিচে একবার বেকায়দায় পড়লে জুতো ফুটো হয়ে ব্যথা পেতে পারো। আমাদের যারা স্যান্ডেল পায়ে এসেছে তাদের দিকে তাকাও, আমাদের চাইতে হাঁটার গতি ওদের অনেক কম, আর খালিপায়ে যারা? তুমিই বলো কেন তারা খোলা জায়গায় বসে আছে?
দেখো, চারদিক আবারো কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে আবার, এখানে হাত দশেক দূরেও কিচ্ছু দেখতে পাবে না তুমি, শুধুমাত্র আবছা একটা ছায়া ছায়া ধোঁয়াশা ছাড়া, আমরা এখন কুয়াশা সরে না যাওয়া পর্যন্ত সব একত্রে এক জায়গায় দাঁড়াবো। বসতে চাইছো? এই গাছের গুড়িতে বসতে পারো। কী বললে? জোঁক? নাহ্, নোনা পানিতে জোঁক থাকে না, তবে গুড়ির খোঁড়লে কাঁকড়া পেতে পারো কিংবা গুঁড়ি থেকে কয়েক হাত উপরে শামুক, পানি নেমে গেলেও ওরা নামার সুযোগ পায়নি। গার্ড দুজনকে খেয়াল করেছো? রাইফেল তাক করে আমাদের দুপাশে কেমন দাঁড়িয়ে গেলো? ওরা আমাদের চাইতে সুন্দরবন অনেক ভালো চেনে, এই প্রকৃতিই ওদের অন্ন যোগায় তাই এই প্রকৃতিকে ওরা চেনে, ওদের দৃষ্টি খেয়াল করো, আমাদের মতন সামনের দিকে না তাকিয়ে কেমন নিচের দিকে তাকিয়ে আছে? ওরা জানে বিপদ এলে তা আসবে নিচের দিক থেকেই, কুয়াশা সরে না যাওয়া পর্যন্ত দেখো ওরা এভাবেই আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকবে, প্রমাণ চাও? ছবি তোলার জন্য একটু এদিকে ঘুরে দাঁড়াতে বলে দেখো তোমার কথার পাত্তাই দেবে না এখন।
আহ্, চিৎকার করো না, তোমাকেই বা কী বলবো, আমারই খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে এখন। পাতার আড়াল থেকে কুয়াশা ছিঁড়ে আসা এ আলোর রূপ সুন্দরবনের গভীরে বসে আস্বাদন করার আনন্দই আলাদা। দেখো, সব ভুলে সবাই কেমন ছোটাছুটি করে ছবি তুলছে। তুমি কী জানো বাংলাদেশের সেরা সেরা কয়েকজন ফটোগ্রাফার এখন আমাদের সাথে? তুষার, আখলাস, হাসান, মাহবুব এরা সবাই আন্তর্জাতিক মানের তাছাড়া আমাদের শাওন, জাহিদ, জিলাল, রাশেদ, পারভেজ কিংবা মফিজ ভাই প্রত্যেকের ঝুলিতে বেশ কয়টা পুরস্কার আছে শুধুমাত্র ছবি তুলে। তাদের তুলনায় আমি নস্যি। ওরা ছবি তুলুক, আমি বরঞ্চ তোমার সাথে গল্পই করি।
কী গল্পই বা করবো তোমার সাথে? এই নির্জন, নিস্তব্ধ গহীন বনে এসে ছেলেটার জন্য মন খারাপ লাগছে আমার। ওর জন্য তোমার মনটাও যে ভালো নেই তা গতকালই টের পেয়েছি আমি। দুবলায় হঠাৎ পাওয়া মোবাইল কানেকশনে মাতিসকে যখন জিজ্ঞেস করলাম “কেমন আছো, বাবা?”, সে উত্তর দিলো ভালো নেই। আমি তো আমার ছেলেকে চিনি, সে যখন বলেছে ভালো নেই নিশ্চিত কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে তখনই আন্দাজ করেছিলাম। নিজে থেকে বলেনি দূরে থেকে দুশ্চিন্তায় যাতে আমাদের বেড়ানোর আনন্দ মাটি না হয়। অথচ দেখো তাকেও কিন্তু আমাদের সাথে চলে আসতে বলেছিলাম, কিন্তু তার কথা ছিলো আমাদের সাথে তো আরো বেড়াতে পারবে সে, কিন্তু ওর প্রবাসী চাচাত ভাইয়েরা তো চলে যাবে কদিন পরই, তাদের সাথে দাদাবাড়ি যাবার আনন্দটা সে কোনোভাবেই ফেলে দিতে পারছিলো না। সে আনন্দে এখন উঁচু খড়ের পালা থেকে পড়ে গিয়ে পুরো হাতে প্লাস্টার নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। দশ পেরুলো ছেলেটা, দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে।
উঠছো যে? ও, ওদিকে যাবে? চলো। হ্যাঁ, সূর্য এখন রঙ ছড়াতে শুরু করেছে, চমৎকার আলোছায়ার খেলা চারদিক। আর আলোগুলোও কেমন অদ্ভুত, সোনালি আলো আস্তে আস্তে সরে যায়, ছড়িয়ে যায় আর কোথাও কোথাও হালকা থেকে আস্তে আস্তে তীব্র হয়ে উঠছে। ছবিতে এ রঙ ধরার ক্ষমতা এখনও হয়নি আমার। চলো তো দেখি সবাই উপুড় হয়ে কীসের ছবি তুলছে সেখানে, ওহ্ এটা একটা নালা, প্রায় শুকনো কাদাহীন নালায় ভেজা ভেজা শূলগুলোতে রঙের কী অদ্ভুত খেলা। চমৎকার একটা দৃশ্য। এ নালা আর কিছুক্ষণ পরই জোয়ার এলে পানিতে ডুবে যাবে, তখন কী আর কল্পনায় আসবে কিছুক্ষণ আগেই এখান থেকে কোনো অনুভূতি নিয়ে ফিরেছি আমরা।
ফেরার কথা বলতেই দেখো ঘড়িতে তাকালাম। আচ্ছা, তাড়া লাগাও সবাইকে। একসাথে এক লাইনে ফিরতে হবে আমাদের। ঐ যে সোজা রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে, দেখো দেখো শেষ মাথায় একটা হরিণ কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে, সে রাস্তা ধরে প্রায় আধ কিলোমিটার ভাঙা কাঠের রাস্তার উপর দিয়ে ফিরবো আমরা। পুরোনো কাঠে পা ফেলতে সাবধান, একদম মাঝবরাবর দিয়ে হাঁটতে হবে তাতে নিচের বিমটা সাপোর্ট হিসাবে কাজ করবে, কাঠ ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা কম। দেখো আমরা উঠতেই সবাই বুঝে গেলো এখন ফেরার পালা। আগামী কিছুসময় এমনকি নাস্তা করবার পরেও দেখবে এদের ছবি নিয়ে কথা বলার বিরাম নেই, কে কেমন ছবি তুললো কিংবা কার তোলা কোন ছবিটা ভালো হয়েছে এসব নিয়ে কথা বার্তা চলতেই থাকবে পরবর্তী কয়েক ঘন্টা। এসবে যোগ না দিয়ে বরঞ্চ আমরা চলো অপেক্ষা করি কেওড়াশুটিতে করা আলমগীর ভাইয়ের ভিডিও দেখার।
সোমবার, জুলাই ০৫, ২০১০
Feast of La Mercè 2009
প্রতি বছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তায় বার্সিলোনা সব উৎসবের সেরা উৎসব “Feast of La Mercè” পালন করে থাকে। ওদের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে এ উৎসবের সাথে সংশ্লিষ্ট। বার্সিলোনার অত্যন্ত জনপ্রিয় এ উৎসবের সময় পুরো শহরই উৎসবের মঞ্চে রূপান্তরিত হয়। ঐতিহ্যবাহী লোক কাহিনিভিত্তিক নাটক, পালা, গান থেকে শুরু করে আধুনিক কনসার্ট কিংবা নাচের অনুষ্ঠান সেপ্টেম্বরের ২৩ থেকে ২৬-২৭ তারিখ পর্যন্ত বার্সিলোনাবাসীর রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।
৬০০ মঞ্চের এ বিশাল আয়োজন কিন্তু কোথাও কোনো বিশৃংখলা নেই। আর তা সম্ভব হয় স্থানীয়দের সতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আর প্রশাসনের সুনিপুণ তত্বাবধানে। এক বছরের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শুরু হয় পরবর্তী বছরের পরিকল্পনা, আর এতে অর্থ যোগানোর জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ উৎসবের সমস্ত আয়োজন সকল দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তাই পর্যটকদের কাছে এর আবেদন অনেক বেশি।
২০০৯ এর সেপ্টেম্বরের ২৪ তারিখ দুপুরের পর গেস্টহাউসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, এমন সময় বাইরে অনেক্ষণ যাবৎ বিউগল, বাঁশি আর ড্রামের একটানা চলমান সুরে বুঝতে পারলাম সামনের রাস্তায় কোনো আনন্দমিছিল হচ্ছে। কৌতূহল মেটাতে বারান্দায় আসতেই দেখি এলাহি কারবার। ছোট্ট গলি মতন রাস্তার দুপাশে হাজার হাজার মানুষ গিজগিজ করছে আর এর মাঝখান দিয়ে হেসে খেলে বাজনা বাজিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে দৈত্যাকৃতির সব মানুষ। একদলের পেছনে আরেক দল, তারপর আরো, এর কোনো বিরাম নেই। বারান্দা থেকে কিছুক্ষণ দেখে নিচে নামলাম, যতদূর চোখ যায় কেবল মানুষ আর মানুষ, ছেলে, বুড়ো, বাচ্চা সবাই আছে, এরই মাঝে ছোটরা ফুটপাথ ধরে বসে গেছে আর বড়রা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে।
একটার পর একটা বাজনা বাজিয়ের দল আসছে, এদের মধ্যমণি হয়ে আছে দৈত্যাকৃতির কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র। রাজা-রানী, জলদস্যু, বীর যোদ্ধা, নাবিক, আবিষ্কারক, নর্তকী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের চেহারাধারী এদের কেউ কেউ আবার চারদিকে চকোলেট বিলিয়ে দিচ্ছে।
কয়েক কিলোমিটার লম্বা এ মিছিল আমার সামনে দিয়ে যেতে দুঘন্টার উপর সময় নিলো।
আজকের ছবির গল্প এই দৈত্যাকার পুতুল আর তাদের মিছিল নিয়েই, চলুন তাদের কিছু ছবি দেখা যাক।