সোমবার, ফেব্রুয়ারী ২২, ২০১০

পাত্রখোলা আর সাতছড়ি

চারদিক নিশ্চুপ, অন্ধকার, বাগানের ভেতরকার সবচাইতে উঁচু পাহাড়ের উপর বিশালকায় বাংলোর আশেপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা বিরামহীন শীষ ছাড়া শোনা যায় রাত জাগা কাঠ ঠোকরার ঠক ঠক। হিম হিম ঠাণ্ডায় স্লিপিং ব্যাগের ভেতর শুয়ে শুয়ে নিদ্রাদেবীকে আকর্ষণের চেষ্টা সবেমাত্র সফল হতে যাচ্ছে তেমন সময় আদিবাসী গার্ডের ভাঙা গলা বেজে উঠে। নিশিপাওয়া মানুষের মতো বিছানা ছেড়ে উঠে আসি এক এক করে। হেঁটে হেঁটে বাংলোর পেছনে এসে আবিষ্কার করি চারজন আদিবাসী আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসে গান গাইছে
...তেরা সিথা নয়নে কাজল ক্যান ছোড়ি বুঝায়া বোল আধা দিনে হবি ডামাডোল
ওরে তোর নয়নে পানি ঝিলিমিলি, ছাড়িয়া নামি হাঁটু পানি
আমি বসি সিনান করি ক্যামনে শুকাই গতর খানি...

রাত আস্তে আস্তে বাড়ে, কিন্তু সময় থেমে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো বসে বসে গান শুনি, স্থানীয় ভাষার গানের কলি আবার বাংলায় ভাষান্তরিত হয়। গানের রসের সাথে লবণ দেয়া সোনালী রংয়ের চায়ে হাফহাতা গেঞ্জী পেরিয়ে শীত কামড়ে ধরে না।

.........
পাত্রখোলা চা বাগান, নাম যেমন সুন্দর তেমন সুন্দর এর পরিবেশ আর মানুষ। ঠিক সন্ধায় যখন আরো অগুনতি বাগান পেরিয়ে পাত্রখোলায় গাড়ি ঢুকলো এর ব্যবস্থাপক সাকলাইন আমাদের চা খাইয়েই মাধবপুর লেক দেখাতে নিয়ে গেলেন আর আফসোস করতে লাগলেন আজ কেন আকাশে চাঁদ নেই। আমরা আফসোস করি না। অন্ধকার নেমে এলেও আকাশের শেষ লাল আভা লেকের পানিতে ভেসে থাকা গোলাপী পদ্মের সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে একসময় মিলিয়ে যায়, এ সৌন্দর্যের সাথে আফসোস থাকে না। আমরা ফিরে আসি। বাংলোর বিশাল বারান্দায় নিচু একটা টেবিলের চারপাশে গোল করে সাজানো চেয়ারে আলো না জ্বালিয়ে চোখ বন্ধ করে সারাদিনের ক্লান্তি সরিয়ে দেবার চেষ্টা করি। চোখে ভেসে থাকে বাতাসে দুলতে থাকা পদ্মের নাচন, পদ্মের রঙ হয় একবার সাদা একবার সোনালি, পদ্ম উঠে আসে আমাদের হাতে, সোনালি তরল হয়ে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। চুপ হয়ে থাকি আমরা, ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে যায় বাদুড়, একটা লক্ষ্মীপেঁচা ডেকে উঠে, অনুভবে অনুভবে সবার হৃদয়ের শূন্যতায় উজানগাঁ’র গলা হাহাকার নামিয়ে আনে, আমরা সবাই হয়ে যাই উকিল মুন্সি “...তুমি আমি জনমভরা ছিলাম মাখামাখি/আজ কেনো হইলে নিরল মেলো দুটি আখি রে পাখি... শোয়া চান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছো নাকী....।

আমরা কেউই কথা বলি না, এমনকি বেশি কথা বলার সোহেল ভাইও না। তারপরও উঠতে হয়, রাতের খাবারের আয়োজন নিজের বাংলোতে করেছে সাকলাইন। এক গাড়িতে ঠাসাঠাসি করে রওনা দিই। পাহাড়ি রাস্তায় উঁচু থেকে গাড়ি ঝাঁপ দিলে বাস্তবে ফিরে আসি সবাই। কেউ কোমর আর কেউ কেউ মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ঝাল ঝাল মুরগির মাংস দিয়ে পেট পুরে ভাত খাই। আমাদের ঘুম পায়।

.........
ভোরে ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। পুরোনো বিশাল দরজা খুলে বাইরে বেরোলেই ভেজা বাতাসের ছোঁয়া পাই। বারান্দা থেকে দৌড়ে পালায় চারটা কাঠবেড়ালী। খাবারের খোঁজে পাখিগুলো কিচির মিচির করতে থাকে। আমি একা একা হাঁটি, পাহাড় বেয়ে নিচে নামতে থাকি, বৃষ্টিহীন প্রকৃতিতে চা বাগান ধুসর বর্ণের, পূবদিকে দূরে একসারি ছায়া গাছ নিচে আসমানী রংয়ের কুয়াশা ধরে রাখে, সূর্যের আলো তেছরা ভাবে এসে সে রং ফালি ফালি করে কেটে দিয়ে যায়, আমি দেখতে থাকি। এক এক করে সবাই এসে যোগ দেয় আমার সাথে। মাতিস তার ক্যামেরা নিয়ে এখানে ওখানে ছুটে বেড়ায়, কোন সৌন্দর্য রেখে কোনটা ধরবে বুঝতে পারে না।


ধলুয়া কামালপুর সীমান্তের এই বাগানের ভারতীয় অংশে এতদিন শুয়ে ছিলেন আমাদের এক বীরশ্রেষ্ঠ। বাগানের কাছাকাছি সীমানা দেয়া বধ্যভূমি। নানা অজানা শহীদদের সন্মান জানাতেই হয়ত প্রকৃতি নিজের হাতে গড়ে তুলেছে এই বাগান। এরই মাঝে নাস্তার ডাক আসে। নাস্তা করেই আবার ছুটব।


.........
পাত্রখোলাকে বিদায় না জানিয়েই গাড়ি নিয়ে ছুটলাম ফুলবাড়ি, প্রাক্তন বিচারক প্রকৃতির প্রেমে সরকারি চাকুরী থেকে ইস্তফা নিয়ে এখন ফুলবাড়ি চা বাগানের দায়িত্বে। আমাদের আসার কথা শুনেই চা খেয়ে যাবার নেমন্তন্ন দিলেন। মাগুড়ছড়ায় বিস্ফোরণে যেখানে গর্ত তৈরি হয়েছিল ফুলবাড়ি বাগানের সে অংশে এখন পদ্ম ফুটে আছে। ভদ্রলোকের ফুলের সখ। চমৎকার সাজিয়েছেন ফুলের বাগান, তাতে প্রজাপতি আর মৌমাছিরা ঘুরে বেড়ায়। আমিও ঘুরতে থাকলাম ক্যামেরা নিয়ে। নানান রঙের আর বর্ণের ফুল, সব নাম জানি না। একদিন পূর্ণিমা রাতে উনার বাংলোতে থাকার কথা বললেন, বাউলের আসর বসাবেন। আমরা মানা করি না। হেঁটে হেঁটে গেলাম বাংলোর কাছে।


এখান থেকে লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে গাড়ি ছোটালাম। লাউয়াছড়ার মুল অংশে ভেতরে খাসিয়া রাজার বাড়ি, পিকনিক করতে আসা হাজার মানুষের ভীড় আর লাউডস্পিকারের শব্দ সহ্য করে বনে ঢোকা আর তার চাইতে লোভনীয় খাসিয়া রাজার বাড়িতে চা খাবার আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে আস্তে আস্তে লাউয়াছড়া পেরিয়ে শ্রীমঙ্গল ছাড়িয়ে সাতছড়ির দিকে যেতে থাকলাম।


আজকের রাত কাটাব সাতছড়িতে। স্থানীয় মন্ত্রীর অনির্ধারিত যাত্রা বিরতির কারণে সাতছড়ির বনবিভাগের বাংলোতে বেশ ভীড়। অবশ্য আমরা চলে আসাতে মিনিট পাঁচেকের ভেতর উনি চলে গেলেন।


বিকেলে ঢুকে গেলাম বনের ভেতর। ছবির মতন সুন্দর বন, নাম না জানা গাছ, তাতে পাখির বাসা। সূর্য ডোবার আগে আগেই ঘরে ফিরতে থাকল। কিচির মিচির করে খোঁজ নিলো আর কেউ বাকি রয়ে গেলো কি না। একটা বনমোরগ একটানা অনেকক্ষণ ডেকে গেলো। আমরা হাঁটলাম, হাঁটতে হাঁটতে ত্রিপুরা পল্লীতে চলে এলাম। হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিলো ওরা। পাশের বাড়ির ছোট্ট বালক পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে গেলো আমাদের। দুই বাড়ি পর ঘরের দাওয়ায় পড়তে বসে গেছে স্কুল বালিকা, সাথে সাথেই মনে পড়ল এ এলাকায় বিদ্যূৎ নেই।


অনেক রাত পর্যন্ত অন্ধকারে বাংলোর সামনে খোলা জায়গায় বসে আড্ডা দিলাম। বাংলোর বাবুর্চি “সাথীর মা” একটু পর পর চা’য়ের যোগান দিতে থাকল। একসময় ঠাণ্ডায় যখন কাঁপতে থাকলাম তখন উঠে ঘুমাতে গেলাম।


পরদিন আবারো খুব ভোরে ঘুম ভাঙল। ক্ষুধার্ত বানরের দল খাবারের দখল নিতে ঝগড়া বাঁধিয়েছে। আস্তে আস্তে বাংলো থেকে নেমে সামনের রাস্তা পেরিয়ে বনের ভেতর ঢুকলাম। ছোট্ট পায়ে চলা পথ, এলোমেলো, উঁচু নিচু, দুপাশ থেকে জংলী গাছ এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায়, ধরে রাখতে চায়, আমরা হাত দিয়ে সরিয়ে সামনের দিকে হাঁটি, মাথার উপর বড়ো গাছের ছাউনি, তার থেকে টিপ টিপ করে বৃষ্টির মতন শিশির ঝরে পড়ে। আমরা সারি বেঁধে সে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাঁটি, সে পথ একসময় শুকনো পাহাড়ি নালা পেরোয়, আমরা নালাতে নেমে যাই। নিচে সাদা বালি, শুকনো, বৃষ্টি এলেই স্রোতের কারণে এপথে হেঁটে যাওয়া যাবে না। মাকড়সার জাল হাত দিয়ে সরিয়ে আমরা বালিতে হাঁটতে থাকি, দুপাশে খাড়া দেয়াল, কিনারে বাঁশ গাছ, পেছনে বন। এরই ফাঁক গলে সূর্য উঁকি দেয়া শুরু করেছে। আমরাও বুঝতে পারলাম ফেরার সময় হয়েছে।


Inside Satchori reserve forest

Matisse at Patrokhola tea garden